সোহেল সানি : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কি স্রেফ একটি সামরিক হত্যাকাণ্ড? কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল উচ্চবিলাসী নিম্নপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন হত্যাকাণ্ড? নাকি একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড?
আওয়ামী লীগ দাবি করে আসছে, একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় চার নেতা হত্যার মাধ্যমে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। এই ধারণার উদ্রেকের কারণ হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্রোতধারায় একই খুনীদের পরিকল্পনায় ৮১ দিনের মাথায় ৩ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজিবনগর সরকারের নেতাদের হত্যাকাণ্ড। যে সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্থাৎ পাকিস্তানের পরাজয়ের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান ভূখণ্ডে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিকনায়ক ও রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হত্যার সময়ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অপসারিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দিয়েই মুজিবনগর সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামানকে বন্দীদশা অবস্থায় হত্যা করায় আওয়ামী লীগে এ ধারণার উদ্রেককে যথার্থই মনে হতে পারে। এ ধারণাকে প্রকট বা প্রগাঢ় করে তোলে যখন পর্যবেক্ষক মহল দেখতে পান নিহত মুজিবনগর সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরামর্শেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ কর্তৃকই খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারান এবং ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাজধানী কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় স্থানান্তরত্তোর যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা বা সরকার গঠন করা হয়, তা থেকে দূরে রাখা হয় বা দূরে থাকেন খন্দকার মোশতাক।
জানা যায়, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিদ্যুৎ মন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাককে শপথ নিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু মোশতাকই অস্বীকৃতি জানান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। নতুন মন্ত্রিসভায় যোগদান করে খন্দকার মোশতাকও মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে নবাগত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে শপথগ্রহণ করেন। সরকারের অভ্যন্তরীণ উপদলীয় কোন্দলে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছিলেন খন্দকার মোশতাক। কেননা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতার বিপক্ষে একটি কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ারূপেই উপ-রাষ্ট্রপতি- তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের পরামর্শক্রমেই পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে অপসারিত করা হয়েছিল। স্বভাবতই সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীনের পরিণতিতে মোশতাক বেজায় খুশী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু উপ-রাষ্ট্রপতির পদ বিলোপ করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্পমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর স্থলে তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রী করা ছিল, মোশতাকের প্রাথমিক জয়।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরার ছয় দিন আগেই চার জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মুজিব বাহিনীর দুই শীর্ষনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের সমর্থক দুই গ্রুপের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য ও আচরণ আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এ কথাটি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ও তথ্য-বেতার মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে দায়িত্বপালনকারী মিজান চৌধুরীর মতে, স্বাধীনতার পর সরকার গঠন প্রশ্নে মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী মনোভাব ও অবস্থান স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপই তাদের শক্তি প্রদর্শনের মহড়া করে। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রায়, তখন বঙ্গবন্ধু দুই গ্রুপকেই ডেকে দ্বন্দ্ব নিরসনে সমঝোতা করে ফেলার নির্দেশ দেন।
সিরাজুল আলম খান গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শক্তির প্রতিনিধিত্বমূলক একটি অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে গণপরিষদ বাতিল করার পক্ষে অবস্থান নেয়। অপরদিকে শেখ ফজলুল হক মনি গ্রুপ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে “মুজিববাদ” আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সাংবিধানিক সংসদীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। মুজিববাদের পক্ষে শেখ ফজলুল হক মনির গ্রুপে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে সিরাজুল আলম খানের গ্রুপে ডাকসু ভিপি আ স ম আব্দুর রব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ সমর্থকরা আত্মপ্রকাশ করে। ১৯ জুলাই ১৯৭২, ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সিরাজপন্থীরা পল্টন ময়দানে এবং মনিপন্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের আয়োজন করে। দুটি সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করা হয়। বঙ্গবন্ধু দৃশ্যত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যোগদান করে একটি পক্ষ অবলম্বন করায় সিরাজুল আলম খান গ্রুপ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে ফেলে। ছাত্রলীগের এই বিভক্তি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সিরাজুল আলম খানের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে সভাপতি, আ স ম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক ও শাজাহান সিরাজকে যুগ্ম সম্পাদককে করে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ। ছাত্রলীগও পৃথক হয়ে যায়। মুজিববাদী ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয় বেগম মুজিবের বোনের ছেলে তৎকালীন সরকারি তথ্য কর্মকর্তা শেখ শহীদুল ইসলামকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় এম এ রশীদকে।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী ছাত্রলীগের সভাপতি হন আফম মাহবুবুল হক ও সাধারণ সম্পাদক হন মাহামুদুর রহমান মান্না। মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতে, ওই সময়ে সংগঠনে বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং যে ভাবমূর্তি তাতে করে তার নেয়া সমঝোতা উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কেন সফলকাম হলো না তা রহস্যাবৃত।
স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয় মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে। দলের সমাজকল্যাণ সম্পাদক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি কে এম ওবায়দুর রহমান প্রথম বক্তা হিসেবে জোড়ালো যুক্তি দিয়ে বলেন,”বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সভাপতি দুই পদেই থাকবেন।”
সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী তখন বলেন, বঙ্গবন্ধু আপনি যেখানেই থাকুন – দলের নেতা আপনিই, যদি সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলেও যেমন, তেমনি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে শুধু দলের সভাপতি থাকলেও সবাই আপনার কাছেই আসবে। মওলানা তর্কবাগীশ যখন দলের সভাপতি ছিলেন, তখনো নেতাকর্মীরা আপনার (সাধারণ সম্পাদক) কাছেই যেতেন। একটি গণতান্ত্রিক ট্রেডিশন সৃষ্টির লক্ষ্যে আপনি দুটির একটি বেছে নিন। সে ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব আপনি সরকার প্রধান থাকবেন। এতে সভায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। হঠাৎ পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয় আব্দুল মান্নানের দুঃসাহসিক এক বক্তব্যে। বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আব্দুল মান্নান বলেন,”কাদের সিদ্দিকীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে আপনি বলেছেন, কাদের তুই চারজনকে মেরেছিস, চারশ’ লোক মারলেও আমি তোকে কিছুই বলতাম না। প্রকাশ্য সরকার প্রধানের এই বক্তব্যের পর দেশে আইন-শৃঙ্খলা কি করে প্রতিষ্ঠা হবে?
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু এতোটাই উদার ছিলেন যে, সেই টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নানকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেন এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে করেন তথ্যমন্ত্রী। পরবর্তীতে মিজানুর রহমান চৌধুরী ত্রাণ মন্ত্রী হন এবং মন্ত্রিত্ব হারান। ১৯৭৫ সালের বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক শুরু হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আলোচনার সূত্রপাত করেন এই বলে “বঙ্গবন্ধু, আপনি সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে যাচ্ছেন সেটা আসলে কি এবং কেনো তা নিজ মুখে বলুন। আপনি যা বলবেন তাই গৃহীত হবে এবং পরে তা আইনে পরিণত করা হবে।”
বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, আমি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে আগ্রহী, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাই। যারা আমার বক্তব্য সমর্থন করো, তারা হাত উঠাও।” পলকের মধ্যে সভাস্থলে সবার হাত উঠে গেল। জেনারেল (অব.) এম এ জি ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন ওদিনের বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৫ এর সংসদীয় দলের বৈঠকে জেনারেল ওসমানী একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরোধিতা করে বলেন, “আমরা আইউব খানকে দেখেছি, ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুজিবুর রহমান খান হিসাবে দেখতে চাই না।”
বঙ্গবন্ধু সভা কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতাপ্রাপ্তির পরপরই বৈঠক শেষ করেন এবং ডেকে পাঠিয়ে জেনারেল ওসমানীকে বলেন,”Don’t be excited my old friend, people are fed up with fiery speeches. They want some revolutionary changes in the social, political and economic system.”
বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে খন্দকার মোশতাক একদিন বিকালে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে তার আগামসি লেনের বাসভবনে যেতে অনুরোধ করেন। মোশতাক তখন বাণিজ্যমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ওয়াজেদ মিয়া খন্দকার মোশতাকের বাসভবনে যেয়ে দেখেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে। মঈনুল হোসেন চলে যাবার পর খন্দকার মোশতাক ড. ওয়াজেদকে বলেন, “তোমার শ্বশুর যে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছেন সে সম্বন্ধে তুমি কি কিছু জানো কিংবা শুনেছো কিনা? বঙ্গবন্ধুর এটা করা মারাত্মক ভুল হবে।”
এম এ ওয়াজেদ প্রতিত্তোরে বলেন,”কাকা আমি স্বাধীনতার পর থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলি না। আপনি বরং শেখ মনির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন। খন্দকার মোশতাক তখন বলেন, “মনিকে বলে কিছু হবে না, কারণ সে নিজেই তোমার শশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।”
একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে তলেতলে সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যারা তাদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক ছাড়াও ছিলেন বাকশাল সরকারেরই তিন প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন অবশ্য একদলীয় শাসন পদ্ধতির পক্ষে ভোট না দিয়ে সংসদ সদস্য পদ হারান। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও নূরে আলম সিদ্দিকী একদলীয় শাসন পদ্ধতির সমালোচনা করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যপ্রবণ ছিলেন বলে পক্ষেই ভোটদান করেন। তবে মিজান চৌধুরীর ভাষ্য মতে, ওদিন থেকেই নূরে আলম সিদ্দিকী হাতে তসবি গোনা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফাখ্যাত ছাত্রনেতার মধ্যে শীর্ষ নামটিই অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর হাতে আজও তসবি রয়েছে। ২৪ জানুয়ারি ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে শেখ কামালকে বলেন, “আগামীকাল তোর আব্বা রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন, অতএব তোরা রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবনে নাকি ধানমন্ডিস্থ এই তোদের বাসায়ই বসবাস করবি।”
শেখ কামাল জবাবে বলেন, “না, না না, আমরা কোন অবস্থাতেই বঙ্গভবনে যাবো না।” ওই দিন বিকাল ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে দেখেন খন্দকার মোশতাক গেইট হতে বের হচ্ছেন। ওয়াজেদকে দেখে একটু দূরে নিয়ে ফিসফিস করে মোশতাক বলেন, “আগামীকাল তোমার শ্বশুর সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন সেটা শুধু মারাত্মক ভুলই হবে না, দেশে-বিদেশে তার ভাবমূর্তিও অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেতলাতে গিয়ে তোমার শ্বশুরকে বিষয়টি অনুধাবন করানোর চেষ্টা করো। আমি আমার শেষ চেষ্টা করে বিফল মনোরথে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যাচ্ছি।” ড. ওয়াজেদ কিছু বলবেন বলে ঠিক করলেও তা আর হয়ে ওঠে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনারত। রাত সাড়ে ১০টায় শেখ মনি বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে ঢোকেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়।
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। যেদিন বঙ্গবন্ধু “দ্বিতীয় বিপ্লব” ঘোষণা করে সংবিধান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনপূর্বক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সংসদ কক্ষেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল সংসদের শীতকালীন অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরস্থ সড়কের বাসভবনে ফিরেন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়।
বঙ্গবন্ধুরই জ্যেষ্ঠ জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা নিয়ে যে ঘরে বাইরে ব্যাপক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ২৬ জানুয়ারি বিকালে মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
১১ ফেব্রুয়ারি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদ করে সংসদ সদস্য পদে ইস্তফা দেন। কিন্ত অনেকেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করে আসলেও সংসদ সদস্য পদ হারানোর ভয়ে পক্ষেই ভোট দেন। তাদের প্রায় সবাই মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেন। কমরেড মনি সিং এর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি -ন্যাপ বাকশালে যোগ দিলে জাতীয় সংসদের ৮ জন বিরোধী সদস্যের ৪ জন প্রবীণ নেতা অধুনালুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, জাসদের আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও মিস্টার খোয়াই বেয়োজরও বাকশালে যোগদান করেন। যাহোক একদলীয় শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেও যারা বাকশালের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই তাদের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করছি।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া একদলীয় শাসন পদ্ধতি নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। যে অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায় তার “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে কিছু ঘটনা” শীর্ষক গ্রন্থটিতে। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু দেশ বিদেশে একজন জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী ও প্রগতিশীল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরূপে পরিচিত। সারা বিশ্বের যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতো সম্মান মর্যাদা দিয়েছেন, যাদের মধ্যে বিভ্রান্তি শুধু নয়, তার ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হয়ে যাবে। দাতা দেশগুলো সরকারকে যে অর্থ-প্রযুক্তি সাহায্য দানে ইতস্ততই শুধু করবে না, বরং এদের কেউ কেউ তা একেবারে বন্ধও করে দিতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বিকাল পশ্চিম জার্মানির উদ্দেশ্যে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। অপরদিকে একই বছর ২৯ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা (দুই শিশু সন্তানসহ), শেখ রেহানা। তারা বাংলাদেশে ফেরার আগেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এরপর পশ্চিম জার্মানি থেকেই ভারতের দিল্লিতে গমন করেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফেরার আগে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ফিরে যাচ্ছি একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রক্রিয়ার বিষয়ে।
আগেই বলেছি জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর কথা ভ্রুক্ষেপ না করে একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ থেকে ইস্তফা দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ আগস্ট জেনারেল ওসমানী অবৈধ প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন।
প্রসঙ্গত, জিয়াউর রহমানকেও একই দিন প্রেসিডেন্ট মোশতাক সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। এর আগের দিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলীকে কারারুদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। জেনারেল ওসমানী নিশ্চয়ই জেনে শুনে অবৈধ প্রেসিডেন্টের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। তার এতোটাই আনুগত্য ছিল যে, জাতীয় চার নেতা হত্যার খবরে যখন বঙ্গভবনে মোশতাক ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা খালেদ-শাফায়েত বাহিনীর হাতে নাজেহাল হচ্ছিল, তখন তাদের বাঁচাতে এগিয়ে যান জেনারেল ওসমানী। জাতির পিতার হত্যাকারী বাস্টার্ড গালি দিয়ে যখন অভ্যুত্থানকারীরা প্রেসিডেন্ট মোশতাকের দিকে স্টেনগান তাক করেন তখন জেনারেল ওসমানী তাকে রক্ষা করেন। নিহত জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারেরই অধীনে এমএজি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগ লাভ করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে বড় করুণ পরিণতি হজম করতে হয়েছে। যেমন- প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করে জেনারেল ওসমানীকেই “নৌকা” প্রতীক দিয়ে আওয়ামী লীগের মোকাবিলা করতে হয়েছে।
ফিরছি বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন বিষয়ে। এ পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে তার আগামসিহ লেনস্থ বাড়িতে দাওয়াত করেন। মোশতাক তখনও বাণিজ্যমন্ত্রী। ড. ওয়াজেদ বাড়িতে পৌঁছে দেখেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের সঙ্গে আলাপরত। মঈনুল হোসেন চলে যাবার পর মোশতাক ওয়াজেদকে বলেন,”তোমার শ্বশুর যে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছেন সে সম্বন্ধে তুমি কি কিছু জানো কিংবা শুনেছো কিনা? তোমার শ্বশুরের এটা করা মারাত্মক ভুল হবে। “ওয়াজেদ মিয়া প্রতিত্তোরে বলেন,”কাকা আমি স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলি না। আপনি বরং শেখ মনির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন।”
খন্দকার মোশতাক তখন বলেন, “মনিকে বলে কিছু হবে না, কারণ সে নিজেই তোমার শশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।” একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে সংগোপনে মোশতাকের সঙ্গে যোগসাজশ গড়ে উঠেছিল বাকশাল মন্ত্রিসভার তিন সদস্য (প্রতিমন্ত্রী) তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, কে এম ওবায়দুর রহমান ও চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের। মোশতাক প্রেসিডেন্ট হবার পর উপরোক্ত চার নেতা তারও প্রতিমন্ত্রী হন এবং জাতীয় চারনেতাকে বাসা থেকে তারাই বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মোশতাকের মুখের ওপর সরকারে যোগদানের প্রস্তাব ছুঁড়ে মাড়ার কারণে চার নেতাকে কারারুদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর খুনীদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়।
১৯৬৬-১৯৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বপালনকারী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধের খলিফা খ্যাত চার ছাত্রনেতার মধ্যে শীর্ষে অবস্থানকারী অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকী একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি এতোটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত বাকশাল পদ্ধতির পক্ষেই সংসদে ভোট দিয়েছেন। তবে মিজানুর রহমান চৌধুরীর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, “একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের দিন থেকেই নূরে আলম সিদ্দিকী হাতে তসবিহ গুণতে শুরু করেন।”
বলা বাহুল্য, মিজান চৌধুরী পরলোকে। কিন্তু নূরে আলম সিদ্দিকী আজও হাতে সারাক্ষণ তসবিহ গুনেন। আওয়ামী লীগ (মিজান) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইউসুফ আলী মন্ত্রিত্বের টোপ গিলে বিএনপিতে এবং পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মূল আওয়ামী লীগে ফিরে গেলে নূরে আলম সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে তিনিও মূল আওয়ামী লীগে ফিরে এলেও বর্তমানে নিস্ক্রিয় রয়েছেন। তার পুত্র তাহজিব সিদ্দিকী অবশ্য আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগ (মিজান) সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ছেড়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপ গিলেন। পরবর্তীতে এরশাদের বিরুদ্ধেও পৃথক জাতীয় পার্টি করেন। শেষ বয়সে আওয়ামী লীগে ফেরার কিছুদিন পর ইন্তেকাল করেন। ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড়পুত্র
ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। আসা যাওয়া ছিল বঙ্গবন্ধু বাড়িতেও। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন অর্থাৎ সংবিধান চতুর্থ সংশোধন বিল পাস হবার একদিন আগে ২৪ জানুয়ারি (১৯৭৫) বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে শেখ কামালকে বলেন, “আগামীকাল তোর আব্বা প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, অতএব তোরা প্রেসিডেন্টের বঙ্গভবনে নাকি ধানমন্ডিস্থ এই বাড়িতেই থাকবি?”
শেখ কামাল বলেছিলেন, “না,না না, আমরা কোন অবস্থাতেই বঙ্গভবনে যাবো না।” ওদিন বিকালে খন্দকার মোশতাকও একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুর সায় না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ মেজাজ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন মোশতাক। গেইটে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদের সঙ্গে। মোশতাক একটু অদূরে ওয়াজেদকে টেনে নিয়ে বিড়বিড় করে বলছিলেন, “আগামীকাল তোমার শ্বশুর সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন সেটা শুধু ভুলই হবে না, দেশ-বিদেশে তার ভাবমূর্তি অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেতলায় গিয়ে তোমার শ্বশুরকে বিষয়টি অনুধাবন করানোর চেষ্টা করো।
খন্দকার মোশতাক ড. ওয়াজেদকে আরও বলেন যে, “আমি আমার শেষ চেষ্টা করে বিফল মনোরথে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যাচ্ছি।”
ড. ওয়াজেদ শ্বশুরের সঙ্গে দেখা করে এ কথা বলবেন ভাবলেও তা আর হয়ে ওঠে না। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এম মনসুর আলীকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে ১০টায় বাড়িতে ফিরে শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি কক্ষে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত কথাবার্তা শেষ হলে শেখ মনি তার বাসায় চলে যান। পরদিন ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। সংবিধান চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে দেশে কায়েম হয় একদলীয় রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা। এ আমূল পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুর ভাষায় “দ্বিতীয় বিপ্লব।”
প্রেসিডেন্টের আদেশে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ- সংক্ষিপ্ত নাম যার বাকশাল। দলে দলে সরকারি বেসরকারি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আবেদন করে সদস্য প্রাপ্তির জন্য। দ্রুত সুফলও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাতে কি! দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে? মোটেই নয় বরং ষড়যন্ত্র চক্রান্ত আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত যে সত্যাসত্য তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয় গোটা জাতির।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরোধিতা করেও বাকশালের অন্যতম নীতিনির্ধারক ছিলেন। ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রী। সেই মোশতাকই কিনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেন্টের মসনদে উপবিষ্ট হলেন। খুনি ফারুক-রশিদদের “সূর্য সন্তান” হিসেবে অভিহিত করে বললেন, “অন্য কোন উপায়ে স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে উৎখাত করা সম্ভব ছিল না, বিধায় সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সামনে স্বর্ণ দ্বার খুলে দিয়েছে। অথচ ২০/২৫ জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাসহ গোলন্দাজ ও ট্যাংক বাহিনীর ১৪০০ সৈন্য এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। মোশতাকের চারপাশে জড়ো হলো কয়েক ঘণ্টা আগেও যারা বঙ্গবন্ধুর মোসাহেবি করেন সেসব মন্ত্রীরা।
বঙ্গবন্ধুর দুই রাষ্ট্রপতির একজন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আট আগস্ট দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন। সেই তিনি খন্দকার মোশতাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। আরেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহ কিনা মোশতাকের উপ-রাষ্ট্রপতি হলেন। দুই শিক্ষাবিদ ড. আজিজুর রহমান মল্লিক ও ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু যথাক্রমে শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রী করেছিলেন, অথচ সেই দুই ব্যক্তিই মোশতাকের মন্ত্রী হয়ে বসলেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মোমিন, মনোরঞ্জন ধর, আসাদুজ্জামান খান, ফণিভূষণ মজুমদার, সোহরাব হোসেন, প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, ডা. ক্ষীতিশ চন্দ্র মন্ডল, রিয়াজুদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, মোসলেম উদ্দিন খান ও সৈয়দ আলতাফ হোসেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। শুধুমাত্র ফণিভূষণ মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে মন্ত্রীপদে শপথ পড়ানোর কথা শোনা গেলেও অন্যান্যের মন্ত্রী গ্রহণে কোন জোরজবরি ছিল বলে ইতিহাসের সূত্র সাক্ষ্য দেয় না। বরং কে কোন দফতর পাবেন সে নিয়েও খুনীদের দিয়ে তদবির করেন বলে জানা যায়। উপরোক্তদের মধ্যে কেবল মোসলেম উদ্দিন হাবু মিয়া বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সরকারের মন্ত্রী ছিলেন না। ২৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় মন্ত্রিসভার সর্বসম্মতিক্রমে। মন্ত্রিসভায় চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত ছিল “জাতীয় টুপি” আইন ঘোষণা। খন্দকার মোশতাক গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপিটাই হয়ে গেল জাতীয় টুপি।
তবে তাসের ঘরের মতো মাত্র ৮১ দিনের মাথায় অবৈধ ক্ষমতা মোশতাক সরকারের মাথার ওপর ভেঙে পড়লো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্র শুধু নয়, নিজ দলের নেতাদেরও নানা চক্রান্তকে। বড় ট্রাজেডি যে, দল পরিচালনা করতে গিয়ে মোশতাক মন্ত্রিসভারও বহু সদস্যকে অনিবার্য কারণে মেনে নিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে যে সুবিচারের প্রশ্ন স্বভাবতই আসতে পারে। যেমন- আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠন করে। ইনডেমনিটি বাতিল হওয়ার পর শুরু হয় সাধারণ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া। মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকে ইন্তেকাল করলেও বেঁচে ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বডি প্রেসিডিয়ামে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মোমিন, বিশেষ দূত মহিউদ্দিন আহমেদ। মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীও তখনো আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। উল্লেখিত নেতারা সংসদ সদস্য হলেও শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। এতে নেতাকর্মীদের মনে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয় যে, নীতিগতভাবে মোশতাক মন্ত্রিসভার কাউকে শেখ হাসিনার সরকারে দেখা যাবে না। বর্তমানে মোশতাক মন্ত্রিসভার কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু অনেক ছিলেন যাদের অবস্থান স্বীকার করেই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিচালনা করতে হয়।
মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যে ব্যক্তিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান শেষে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ ফেরাউনের হাত হতে রক্ষা পেয়েছে”, সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন স্পিকার আব্দুল মালেক উকিল। তাকেও প্রেসিডিয়ামে রেখে শেখ হাসিনাকে পথ চলতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর কাউন্সিলে সেই মালেক উকিলই আওয়ামী লীগের সভাপতি হন।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আব্দুল মালেক উকিল পরাজিত হওয়ায় যাকে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়, সেই আসাদুজ্জামান খানও খুনী মোশতাকের মন্ত্রী হন। বিরোধী দলের উপনেতা পদটিতেও যে মহিউদ্দিন আহমেদকে সেই তিনিও মোশতাকের বিশেষ দূত হয়ে মস্কো সফর করেন সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন এনে দিতে। বহুল আলোচিত সমালোচিত “বাকশাল” নামকরণকারী ব্যক্তিটি আর কেউ নন, ১৯৭৩ সালে ন্যাপ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী এই মহিউদ্দিন আহমেদই।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন