জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান ও শহীদদের স্মরণে এক স্মরণসভায় তিনি এসব কথা বলেন।
আজ শনিবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আয়োজনে রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই সভা হয়।
সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, গণঅভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা এবং আন্দোলন পরবর্তী বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এখানে কম বেশি যারা আলোচনা করেছেন তাদের আলোচনায় বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে। বক্তব্যের শুরুতেই আমি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ, আহত এবং যারা এখনো চিকিৎসাধীন আছেন তাদের প্রত্যেকের অবদানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দৃঢ়ভাবে একটি কথা বিশ্বাস করি, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে জনগণের হৃদয়ে স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে রয়েছেন এবং থাকবেন, ঠিক একইভাবে, ২০২৪ সালে দেশ এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে শহীদরাও আজীবন জনগণের হৃদয়ে স্মরণীয়, বরণীয় হয়ে থাকবেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ভাই ও বোনেরা, কোটা সংস্কার এবং ফ্যাসিবাদী পতনের দাবিতে গত বছর গণঅভ্যুত্থানের ঠিক এই সময়টি ছিলো অত্যন্ত উত্তাপ।
তিনি বলেন, সেদিন এই সময় রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল ক্যাম্পাস, রঞ্জিত রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল রাজপথ। সেই সময়ে আমার একটি উপলব্ধির কথা, গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির এই অনুষ্ঠানে আজ আমি আপনাদের সাথে আপনাদের সামনে শেয়ার করতে চাই। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে বাসিন আখরামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একই দিনে কমপক্ষে ৬ জন শহীদের আত্মদানের মাধ্যমে ১৬ জুলাই থেকে মাফিয়া সরকারের পতন ঘণ্টা বেজে উঠেছিল। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে মূলত কিন্তু আন্দোলন আর কোটা সংস্কারের দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ঘরভরা যেই মানুষগুলো আজ এখানে উপস্থিত আছেন, কম বেশি সকলেই আপনারা সেই দিনের সাক্ষী ছিলেন। সারা দেশে স্ফুলিঙ্গের মতন ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন দমন করতে, তৎকালীন মাফিয়া সরকার বেপরোয়া হত্যা আর নির্মম দমন-পীড়ন চালাতে শুরু করেছিল।
তারেক রহমান বলেন, সেই মাফিয়া সরকারের গুলি-বন্দুকের ভয়কে উপেক্ষা করে, বিশেষ করে ১৮ জুলাই থেকে দল-মত নির্বিশেষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রীরা যেভাবে রাজপথে সাহসের সঙ্গে নেমে এসেছিলেন, যেভাবে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সেদিন থেকেই আমার চূড়ান্ত বিশ্বাস জন্মেছিল যে, মাফিয়া সরকারের পতন এখন শুধুমাত্রই সময়ের ব্যাপার। এবং সেই উপলব্ধি এবং বিশ্বাস থেকেই ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনকে ফ্যাসিস্ট পতনের এক দফা আন্দোলনে পরিণত করে ফ্যাসিস্টের পতন নিশ্চিত করতে বিএনপিসহ দেশের সকল গণতান্ত্রিক দলগুলো পরিকল্পনা এবং কৌশল অবলম্বন করেছিল। কোটা সংস্কারের বিষয়টি বিএনপির কর্মপরিকল্পনায় অনেক আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আপনাদের হয়তো কারো কারো স্মরণ আছে। তারপরেও আমি বলতে চাই, ২০১৪ সালে ১৫ জুলাই লন্ডনে বিএনপি আয়োজিত এক আলোচনা সভায়, আমি সেদিন কিছু বিষয় বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলাম। সেই অনুষ্ঠানেই সেই বক্তব্যে তখন আমি বলেছিলাম, স্বাধীনতার এত বছর পরেও সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক।
তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে বীর শহীদরা জাতির গৌরব। তারা গণতান্ত্রিকামে মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণা। আবারো তাদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং জানাই গভীর কৃতজ্ঞতা। প্রিয় ভাই-বোনেরা, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ, শহীদদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে শহীদদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইনসাফ এবং ন্যায়ভিত্তিক এবং তাবেদার মুক্ত গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ করার মাধ্যমে আজ আমরা শহীদদের প্রতি সত্যিকারভাবে সম্মান এবং শ্রদ্ধা জানাতে পারি, যা কি না একজন শহীদের বাবার বক্তব্যের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে পরিষ্কারভাবে আমাদের সকলের সামনে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, হাজারো শহীদদের কাঙ্খিত রাষ্ট্র গড়ে তোলার পূর্বশর্তই হচ্ছে জনগণের বাংলাদেশে জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ এবং জবাবদিহিমূলক একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশে এমন একটি গণতান্ত্রিক নিরাপদ নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকা জরুরি, যেখানে প্রতিটি ভোটার নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রয়োগ এবং চর্চার কোনো বিকল্প নেই। এই কথাটিও একজন শহীদের গার্জিয়ানের মুখ থেকে আজ আমরা শুনেছি। হয়তো তারা তাদের ভাষায় বলেছেন, রাজনৈতিক ভাষায় বলেননি। কিন্তু তাদের ভাষার মাধ্যমেও এটি আমরা আজকে শুনেছি।
তারেক রহমান বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, রাষ্ট্রের অপব্যবহার কিংবা প্রশাসনিক কূটকৌশলের পরিবর্তে কারো রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের প্রধান মাধ্যম হওয়া দরকার জনগণের রায়, জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস। আমি আমার বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার একটি কথা বলি। এবং সেটি হলো দেশের জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা না গেলে আমাদের কোনো আইনই শেষ পর্যন্ত কিন্তু কোনো কাজে আসবে না, টেকসই হবে না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি দেশে সংঘটিত কিছু নৃশংস এবং অনাগত ঘটনা জনমনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরো স্বচ্ছ এবং সাহসী ভূমিকা রাখুন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনগণ আপনাদের পাশে থাকবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো আপনাদের পাশে থাকবে, যদি আপনাদের ভূমিকা আরো স্বচ্ছ এবং সাহসী হয়।
তারেক রহমান বলেন, এবার আমি দেশের শিক্ষার্থী এবং তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে দুই একটি কথা বলতে চাই। আজকের তারুণ্যই আগামী বাংলাদেশ। ছাত্র তরুণরা অবশ্যই রাজনীতি করবেন। রাজনৈতিকভাবে সচেতন থাকবেন। ছাত্র-তরুণদের সাহসী অংশগ্রহণ ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশেই স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদীর বিরুদ্ধে বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার উদাহরণ খুবই বিরল। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আপনাদেরকে সবার আগে জ্ঞান, বিজ্ঞান, মেধা, মননে, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতায় আরো সমৃদ্ধ হতে হবে। আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে শিক্ষার্থী যারা আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে, বর্তমানে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শুধু স্লোগাননির্ভর কিংবা প্রচলিত প্রথাগত রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে ২০২৪ সালের শহীদ, ১৯৭১ সালের শহীদদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। শহীদদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে চাইলে অবশ্যই আপনাদেরকে নিজেদেরকে যোগ্য মানুষ এবং যোগ্য নেতা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এবং সেই মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলোকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত রাখতে হবে। আপনাদেরকে অবশ্যই পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি লেখাপড়াই হতে হবে আপনাদের প্রথম এবং প্রধান অগ্রাধিকার।