সংগৃহীত ছবি
অনলাইন ডেস্ক : জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ফ্যাসিবাদ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই হবে। সে লড়াইয়ে আমরা জিতবো। আমরা কথা দিচ্ছি, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে কৃষক ও শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করবো। পিলখানা, শাপলা ও জুলাইসহ প্রতিটি গণহত্যার বিচার করবো। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি, আমরা তাদের কাছে ঋণী। যতদিন জামায়াতের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন যেন তাদের ঋণ পরিশোধ করতে পারি।
শনিবার (১৯ জুলাই) বিকালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাত দফা দাবিতে জামায়াতের জাতীয় সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. শফিক বলেন, ২৪ এর শহীদদের প্রতি যেন কোনও অবজ্ঞা না করা হয়। আবু সাঈদসহ অন্যান্যরা বুক পেতে না দিলে হয়তো আমরা মুক্ত পরিবেশ পেতাম না।
তিনি বলেন, কোনও ছোট দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যাবে না। যারা এগুলো করবেন বুঝতে হবে তারা ফ্যাসিবাদ লালন করেন।
হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বসে বক্তব্য দেন জামায়াতের আমির
কয়েক মিনিট বক্তব্য দেওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান হঠাৎ ডায়াসের সামনে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় নেতাকর্মীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। মঞ্চে থাকা অন্যান্য নেতারা তাকে তুলে ধরেন। দ্বিতীয়বার আবারও বক্তব্য দিতে গিয়ে অসুস্থবোধ করেন। তখন চিকিৎকরা তাকে বক্তব্য দিতে দিতে না করলেও শোনেননি। তৃতীয়বার তিনি বসেই বক্তব্য দেন। তখন নেতাকর্মীরা কিছুটা শান্ত হন। পরবর্তীতে দ্রুত সমাবেশ সমাপ্ত ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। আমিরকে সরাসরি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য এটিএম আজহার বলেন, ইসলামী আন্দোলন নিশ্চিন্ন করা যায়নি। জামায়াতের নেতারা পালায়নি। মীর কাশেম আলী পালাননি। বিদেশ থেকে ফেরত এসে গ্রেফতার হন। যারা জামায়াতকে উপড়ে ফেলতে চায় তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, জামায়াত কোনও প্রচলিত দল নয়, পূর্ণাঙ্গ ইসলামী দল।
নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অপ্রসাঙ্গিক। জামায়াত নতুন বাংলাদেশ চায়। পিআর পদ্ধতির ছাড়া নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। জামায়াত সব শ্রেণির মানুষের দল। জামায়াত কোনও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয় না। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের স্থান নেই। আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবো।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জামায়াতের বৃদ্ধ নেতাদের ফাঁসি দিয়েছে শেখ হাসিনা। নিবন্ধন কেড়ে নিয়েছে ও নিষিদ্ধ করেছে। জামায়াত মজলুম দল। বেশিরভাগ শহীদ পরিবারের পাশে জামায়াত দাঁড়িয়েছে। জামায়াতের আমির মানবিক নেতা। একটি কল্যাণ ও সুশাসনের রাষ্ট্র করতে চায় জামায়াত। তরুণ প্রজন্মের প্রথম ভোট দাঁড়িপাল্লার পক্ষে হোক।
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, গণহত্যার বিচারের নামে কোনও তামাশা জনগণ মানবে না। সরকারের ভেতরে বাইরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচার করতে হবে।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, নির্বাচনকে কালো টাকা, ফ্যাসিবাদমুক্ত ভোটাধিকারের জন্য পিআর পদ্ধতি অপরিহার্য। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই এর পক্ষে।
শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, শহীদ পরিবার বিচার পাচ্ছে না। এটি দুঃখজনক। জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি দিয়ে জুলাই সনদ ঘোষণা করতে হবে। তিনি শিক্ষা সংস্কারের কোনও কমিশন গঠন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শিক্ষাঙ্গণে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দাবি করেন। তিনি অভিযোগ করেন একটি পক্ষ বিরোধিতা করছে।
জামায়াত নেতাদের মধ্যে আরও বক্তব্য রাখেন যারা
সমাবেশে জামায়াত নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় সভাপতি অ্যাডভোকেট জসীম উদ্দিন সরকার, ড. ফায়জুল হক, শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, কেন্দ্রীয় নেতা সাদিক কায়েম, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আতিকুর রহমান।
অন্য দলের নেতাদের মধ্যে যারা বক্তব্য রাখেন
হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী, ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, এনসিপির মুখ্য উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সার্জিস আলম, বাংলাদেশ নেজামে ইসলামী পার্টির মহাসচিব মুসা বিন ইজহার, বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ্র চন্দ্র প্রামাণিক, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আবু জাফর কাসেমী, নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম, জাতীয় গণতান্ত্রিক দল জাগপার সহ-সভাপতি ও মুখপাত্র রাশেদ প্রধান।
উপস্থিত ছিলেন জুলাই যোদ্ধা ও শহীদদের পরিবারের সদস্যরা
শহীদ পরিবারের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আবু সাঈদের ভাই আবুল হোসেন ও রমজান হোসেন, ইমাম হাসান তাইয়িমের ভাইসহ আরও কয়েকজনের স্বজনরা।
আহত জুলাই যোদ্ধাদের মধ্য থেকে বক্তব্য রাখেন জুলাই যোদ্ধা জুনায়েদ হাসান, রেদোয়ান নাবিল, এম এইচ মোস্তাফিজুর রহমান ও শাহ আলম।
বুয়েটের আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, দেশের পক্ষে কথা বলায় ২০১৯ সালে তার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তিনি এ হত্যার বিচার দাবি করেন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বড় ভাই রমিজ আলী নির্বাচনের আগে হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন।
নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস
বেলা ২টায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও ভোর থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন নেতাকর্মীরা। ব্যানার-ফেস্টুন ছাড়াও অনেকের হাতেই ছিল দলীয় প্রতীক ও নেতাদের ছবি। বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে ঢাকার বাইরের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন।
সমাবেশ বাস্তবায়নে গত এক মাস ধরে সারা দেশে প্রচারণা ও গণসংযোগ করেন দলের নেতাকর্মীরা। পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে যায় ঢাকার অলিগলি। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সাঁটানো হয় বড় বড় বিলবোর্ড। সমাবেশস্থলকেও সাজানো হয় বর্ণিল সাজে।
সমাবেশের বিস্তৃতি
সকাল ১০টা থেকেই বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতারা বক্তব্য রাখেন। ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিলেন সাইমুমের শিল্পীরা।
দুপুর নাগাদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিপূর্ণ হয়ে নেতাকর্মীদের বিস্তৃতি আশপাশের এলাকা রমনা পার্ক, মৎস্য ভবন, কদম ফোয়ারা, শাহবাগ ও টিএসসি মোড় পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।
যে সাত দফা দাবিতে সমাবেশ
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সব গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, ‘জুলাই সনদ’ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন ও এক কোটিরও বেশি প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ।
সাইমুমের শিল্পীদের পরিবেশনায় ভিন্নমাত্রা
সকাল থেকেই বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে চলে জামায়াতের সাংস্কৃতিক সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এতে সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে নাটিকা, বিপ্লবী কবিতা ও জাগরণী গান নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাসের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সাইমুম ছাড়া তাদের অন্যান্য সংগঠনও এতে অংশগ্রহণ করে।
যাত্রী-পথচারীদের দুই ধরনের দুর্ভোগ
ঢাকায় জামায়াতের সমাবেশ কেন্দ্র করে শনিবার (১৯ জুলাই) দিনভর দুই ধরনের দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী ও পথচারীরা। এর মধ্যে সকাল বেলায় অধিকাংশ সড়কেই নগর পরিবহনের বাস ছিল সীমিত। এতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও গাড়ি পেতে বেগ পোহাতে হয়েছে। এতে বাধ্য হয়েই অনেকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা দেন। আর দুপুর নাগাদ কিছু গাড়ি নামলেও তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে
গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও কাকরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, ঢাকার বাইরে থেকে আসা কয়েকশ যানবাহন বিভিন্ন সড়কে পার্কিং করে রাখা হয়েছে।
দুপুরের পর গুলিস্তান থেকে শুরু করে আশপাশের সব সড়ক থেকে মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দীর দিকে আসেন। আর সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্তও একই অবস্থা। এতে করে এসব সড়ক এড়িয়ে গণপরিবহন চলছে বিকল্প পথে। বিশেষ করে মৎস্য ভবন মোড় দিয়ে শাহবাগ ও ফার্মগেটগামী গাড়িগুলো চলে হেয়ার রোড ও কাকরাইল দিয়ে। মানুষের চাপে রিকশায় চলাও কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া সড়কে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটের জন্য দুর্ভোগ বেড়েছে বলে জানান যাত্রী ও পথচারীরা।
অবশ্য যানজটসহ সম্ভাব্য দুর্ভোগের জন্য রাজধানীবাসীর কাছে আগেই (১৬ জুলাই) ক্ষমা চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।