একাধিক গোয়েন্দাসূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, যশোর সীমান্ত দিয়েই প্রধানত ভারতীয় অস্ত্র আসে। বোনাপোল সীমান্তের কাছে পুটখালী নামে একটি গ্রাম আছে। এর অন্যদিকে ভারত। ভারতের ওই এলাকায় কমপক্ষে তিনজন অস্ত্র ব্যবসায়ী আছেন, যারা বাংলাদেশে অস্ত্র পাঠান। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে অবৈধ অস্ত্রের কারখানা আছে। যশোর ছাড়াও নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জকেন্দ্রিক অস্ত্র চোরাচালান চক্র আছে। আছে ভারতীয় অস্ত্র চোরাচালান চক্রও। আর বান্দরবানভিত্তিক গ্রুপগুলো অস্ত্র আনে মিয়ানমার থেকে।
র্যাব ও পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, র্যাব ও পুলিশ বছরে গড়ে ২০০ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে। বিজিবির হাতে ধরা পড়ে গড়ে দেড় শতাধিক অস্ত্র। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্ধারের অন্তত তিন গুণ অস্ত্র দেশে প্রবেশ করে। আর এর বেশির ভাগই সংগ্রহ করছে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা। এদের আবার অনেকেই ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের অঙ্গসংগঠনের পদধারী। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপক চাহিদা হবে বলে ধারণা তাদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রাজধানীতে ঢুকছে অবৈধ অস্ত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন অস্ত্রের চোরাকারবারিরা। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অস্ত্র আনার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীদের। সাধারণত গণপরিবহনে যাত্রীবেশে এসব অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসেন চক্রের সদস্যরা। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। একাধিক সংস্থার তথ্য বলছে, স্থল ও জল পথের ৩০ রুটে দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র আনা হচ্ছে। অস্ত্রের সবচেয়ে বড় চালান ঢুকছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়টি দুর্গম রুট দিয়ে নিয়মিত অস্ত্রের চালান ঢুকছে। এ ছাড়া শার্শার বেনাপোল স্থলবন্দর, চৌগাছার শাহজাদপুর, হিজলা, আন্দুলিয়া, মান্দারতলা, বেনাপোলের সীমান্তের গোগা, কায়বা, শিকারপুর ও দৌলতপুর সীমান্ত অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের পছন্দের রুট। বিভিন্ন চোরাচালান পণ্যের মধ্য দিয়ে আনা হচ্ছে এসব অস্ত্র। এর বাইরে সাতক্ষীরা সদরের কুশখালী ও গাজীপুর ঘাট দিয়ে মাঝেমধ্যেই অস্ত্র বাংলাদেশে ঢুকছে। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ভোলা নদী হয়ে এবং মোরেলগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলা দিয়ে বলেশ্বরী নদীপথে অবৈধ অস্ত্র হাতবদল হয়। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, দিনাজপুরের হিলি, কুড়িগ্রামের দুর্গাপুর ও নাগেশ্বরী, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙার বরকল ও বাঘাইছড়ি, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর দিয়ে অবৈধ অস্ত্র আসছে। সিলেটের তামাবিল ও কুমিল্লা সীমান্ত দিয়েও আসছে অবৈধ অস্ত্র। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ডিএমপিতে অস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। অপরাধীরাও জানে এসব বিষয় মিডিয়ার মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জেনে যাবে। তবে যেহেতু সামনে নির্বাচন তাই কিছু অপরাধীর চাহিদা বাড়বে। দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের কারণে হয়তো বাড়বে এসব ‘কামলা’র তৎপরতা। তিনি বলেন, ‘আমরা জামিনে থাকা কিছু ব্যক্তিকে নজরদারির মধ্যে রেখেছি। এদের অনেকেই অতীতে অবৈধ অস্ত্র-সংক্রান্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।’ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে গত নয় মাসের চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার ৩৮৭ ঘটনায় ৫৮ জনের মৃত্যু ও প্রায় ৫ হাজার ৪০০ জন আহত হয়েছেন।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বলেন, ‘অন্য সময়ের তুলনায় অপরাধীদের কাছে অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ সামনে নির্বাচন। তবে অপরাধীদের কাছে আমাদের বার্তা হলো, কেউই কিন্তু নজরদারির বাইরে নন। এরই মধ্যে র্যাব অনেক সফল অপারেশন করেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মাদ আলী শিকদার বলেন, ‘বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের সংখ্যা নিয়ে খুব একটা গবেষণা নেই। তবে কেন, কীভাবে, কোথা থেকে আমাদের দেশে অবৈধ অস্ত্র ঢোকে তা কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অবগত। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে তো উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা নয়।’ পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) হায়দার আলী খান বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের কোনো তথ্য পেলে কোনো বাহিনীই বসে থাকে না। তাৎক্ষণিকভাবে তা উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সীমান্তের বিষয়টি বিজিবির আওতাধীন। তবে প্রতিটি সংস্থাই তাদের সর্বোচ্চটা দিচ্ছে বলে আমরা মনে করি।’ ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের বিষয়ে তালিকা এবং তথ্য দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি আছে। আমরা আমাদের প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত তথ্য তাদের দিই। অবৈধ অস্ত্র-সংক্রান্ত সবকিছু তাদের অবহিত করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।’ সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন