লাল ফিতার নতুন প্যাঁচে পড়েছে জমি কেনাবেচা। জমির নামজারিতে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার নতুন বিজ্ঞপ্তিতে তৈরি হয়েছে জটিলতা। এতে ফাইলের স্তূপে বাড়ছে ভোগান্তি। রেজিস্ট্রি কমে যাওয়ায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। জমি কিনতে গিয়ে জটিলতায় পড়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত করে সরকারকে বিপাকে ফেলতে চলছে উন্নয়ন ঠেকানোর নীলনকশা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারকে দুর্বল করতে নেওয়া হয়েছে এ পরিকল্পনা। শিল্পায়নে আগ্রহী হচ্ছে কোম্পানিগুলো, বাড়ছে এ খাতে বিনিয়োগ। সারা দেশে কর্মসংস্থান করতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে কোম্পানিগুলো। কিন্তু জমি কিনতে গিয়ে বাধছে বিপত্তি। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি যদি কোম্পানি কিনতে যায় তাহলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। এরপর এ জমি রেজিস্ট্রি করে নামজারি করতে গেলে আবারও অনুমতি লাগবে। আগে নামজারি করতে শুধু সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে আবেদন করলেই হতো। এখন অনুমোদনের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অনুমতি মিললে এরপর শুরু হচ্ছে খারিজের মূল কার্যক্রম। অনুমতি নিয়ে তারপর সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে আবেদন করতে হচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে দীর্ঘসূত্রতা। আবেদন করে ৪৫ দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। দুই দফা অনুমতির গ্যাড়াকলে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। অনুমতি নিতে গিয়ে কোম্পানি এ পর্যন্ত কত পরিমাণ জমি কিনেছে এর নথি জমা দিতে হচ্ছে। ফাইলের স্তূপ কমাতে সরকার অনলাইন নামজারির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু নতুন এই বিজ্ঞপ্তিতে ভেস্তে যাচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে অনলাইন নামজারির প্রক্রিয়া।
কোম্পানি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জমি কেনার জন্য পূর্বানুমতি নিলে খারিজের জন্য কেন আবার অনুমতি নিতে হবে। যাদের প্রকল্প অনুমোদন নেওয়া ছিল তাদেরও এখন জমি খারিজের জন্য অনুমতি নিতে হচ্ছে। এমনকি খারিজের এই আবেদনের কোনো ফরমও তারা তৈরি করেনি। জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনের পর তারা পাঠাবে এসি ল্যান্ডের কাছে। সেখান থেকে জরিপ করে রিপোর্ট পাঠাবে জেলা প্রশাসকের কাছে। তারা আবেদন গ্রহণ করে আবার এসি ল্যান্ডকে বললে তবেই খারিজের প্রক্রিয়া শুরু হবে। গত বছর ১৪ নভেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শিবলী সাদিক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কোম্পানির নামে নামজারি করার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘কোম্পানির নামজারির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকের অনুমতি গ্রহণ করা হচ্ছে না। অথচ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল, ১৯৯০-এর ৩২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, সমবায় বা হাউজিং কোম্পানি জমি কিনলে প্রথমে তা সমিতি বা কোম্পানির নামে নামজারি হতে হবে। কোম্পানি বা সমিতি জমি কেনার পর সেটার নামজারি করার জন্য নির্দেশ দিতে হবে। নামজারির আবেদন পাওয়ার পর নামজারি কর্তৃপক্ষ জমি মালিকানার প্রচলিত ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করেছে কি না বা কৃষিজমি কেনার ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করেছে কি না তা নিরীক্ষা করবেন। মালিকানার উচ্চসীমা অতিক্রম করা হয়ে থাকলে বা কেনার পূর্বানুমোদন না থাকলে সহকারী কমিশনার আইনবহির্ভূত কাজের জন্য জমি বাজেয়াপ্তের কেস রুজু করবেন এবং কালেক্টরকে জানাবেন। কালেক্টরের অনুমোদনক্রমে বাজেয়াপ্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। কালেক্টরের সুস্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোম্পানি বা সমবায় সমিতির নামে নামজারি করা হবে না। কোম্পানির নামে নামজারি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালের ৩২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার জন্য বলা হলো। নইলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
জানা যায়, এই বিজ্ঞপ্তি জারির পর থেকে কমে গেছে জমি রেজিস্ট্রির পরিমাণ। কারণ অনুমতির অপেক্ষায় জমে আছে ফাইলের স্তূপ। দুই দফা অনুমতি নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করতে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। যমুনা বিল্ডার্স লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. আবদুল কাদের বলেন, ‘কোম্পানিগুলোর জমি কিনতে গেলে অনুমতি নিতে হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া কেনার প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। অনুমতির জন্য যাবতীয় সমস্ত নথি দাখিল করতে হচ্ছে। ভোগান্তির তো একটা সীমা আছে! জমি কেনার হয়রানি কয়েক গুণ বেড়েছে। জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে কেনার অনুমতি নিলে আবার খারিজ করতে কেন অনুমতি লাগবে? এসব হয়রানির কারণে জমি কেনায় আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। শিল্প খাতে বিনিয়োগে ঝামেলা বাড়ায় বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবে।’ ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে এক পরিবার ৩৭৫ বিঘা বা পরিবারের সদস্যপ্রতি ১০ বিঘা জমি রাখতে পারবে। পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের ওপর বিভিন্ন আদেশ, অধ্যাদেশ ও সংশোধনীর মাধ্যমে ভূমি আইনের ব্যাপক সংস্কার হয়। ১৯৭২ সালের জারি করা রাষ্ট্রপতি আদেশ ৯৮ ও ১৩৫ নামে পরিচিত অধ্যাদেশে দেশের স্বাধীনতার আগে পরিবারভিত্তিক ভূমির সিলিং ৩৭৫ বিঘা ছিল, যা কমিয়ে ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়। ২৫ বিঘা কিংবা এর চেয়ে কম ভূমির মালিকের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ করা হয়। ২৫ বিঘার ওপরে ১ শতাংশ হলেও সম্পূর্ণ ভূমি বা ২৫ বিঘা ১ শতাংশ ভূমির খাজনা পরিশোধ করতে হয়।১৯৮৪ সালের ভূমি সংস্কার আইনে জমি রাখার সর্বোচ্চ সীমা বা সিলিং ১০০ বিঘা থেকে কমিয়ে ৬০ বিঘা করা হয়। কোম্পানির ক্ষেত্রে সিলিং ১০০ বিঘা করা হয়। তবে এই ১০০ বিঘা শিল্পকারখানার জন্য অনেক সময় কম হয়ে যায়। তাই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে এর বাইরে জমি কিনতে পারে কোম্পানিগুলো। কিন্তু একবার অনুমতি নিয়ে জমি কেনার পর খারিজ করতে আবারও ধরনা দিতে হচ্ছে জেলা প্রশাসকের দুয়ারে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অসংখ্য প্রতিষ্ঠান জমি খারিজের জটিলতায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে জমি কেনাবেচা এবং এওয়াজ বদল দলিল সম্পন্ন করতে পারছে না। এ ছাড়া প্রয়োজনে ব্যাংক ঋণের আবেদনও করতে পারছে না তারা। আগের পদ্ধতিতে খারিজ চলমান থাকলে এ সমস্যায় পড়তে হতো না প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
ইউনাইটেড গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জমি ক্রয়) মো. মহসিন আলী বলেন, ‘ডিজিটালাইজেশনের পরিবর্তে জমির খারিজ প্রক্রিয়া জটিল হয়েছে। ভূমি সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি দীর্ঘদিনের। জমির বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও সেবাপ্রার্থীদের অবর্ণনীয় হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নতুন নিয়ম পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে এবং ভোগান্তি দ্বিগুণ করেছে। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতায় জমি কেনা-বেচা, রেজিস্ট্রেশন ও খারিজের কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এক মাস আগে টেস্ট কেস হিসেবে জমি খারিজের অনুমতি চেয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে দুটি আবেদন জমা দিয়েছিলাম। আবেদনপত্র জমা হয়েছে। কিন্তু এসি ল্যান্ড এখনো ডিসি অফিস থেকে আবেদনপত্র পাননি। জমির রেজিস্ট্রি খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’ সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন