যুদ্ধের খরচে নাজেহাল ইসরায়েল, বিপর্যস্ত অর্থনীতি

অনলাইন ডেস্ক : ইসরায়েল ও ইরান টানা সপ্তম দিনের মতো একে অপরকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনা আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে—এই যুদ্ধে দুই দেশের অর্থনীতি কতদিন টিকে থাকতে পারবে?

 

গত শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন এবং কয়েকটি পরমাণু স্থাপনায় ক্ষতি হয়। পাশাপাশি ইরানের জীবাশ্ম জ্বালানি খাতেও আঘাত হানে তেল আবিব। জবাবে ইরান সরকার ভবন ও ইসরায়েলের মহানগর এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

তবে এই সংঘর্ষ শুধু প্রাণহানি নয়, উভয় দেশের জন্যই আর্থিক দিক থেকে বিরাট ক্ষতি ডেকে আনছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দুই দেশকেই অর্থনৈতিক মন্দা ও বাজেট ঘাটতির মুখোমুখি হতে হবে।

 

ইসরায়েলের যুদ্ধ ব্যয় কত?
গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান সামরিক অভিযান ও ইরানের সঙ্গে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘর্ষের কারণে ইসরায়েল ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সময় পার করছে। দেশটির অর্থনৈতিক দৈনিক ‘কালকালিস্ট’ জানিয়েছে, গাজা যুদ্ধেই ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের ২৫০ বিলিয়ন শেকেল (৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার) খরচ হয়েছে।

 

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াই নেট’ বলছে, ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষের প্রথম দুই দিনেই খরচ হয়েছে ৫.৫ বিলিয়ন শেকেল (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার)। এই হারে চললে, মাত্র সাত সপ্তাহের মধ্যেই ইরান যুদ্ধের ব্যয় গাজা যুদ্ধের ব্যয় ছাড়িয়ে যেতে পারে।

 

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০২৩ সালের ৬০ বিলিয়ন শেকেল (১৭ বিলিয়ন ডলার) থেকে ২০২৪ সালে ৯৯ বিলিয়ন (২৮ বিলিয়ন ডলার) হয়েছে। ২০২৫ সালে তা ১১৮ বিলিয়ন শেকেল (৩৪ বিলিয়ন ডলার) ছুঁতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় জিডিপির ৪.৯ শতাংশ বাজেট ঘাটতির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যার পরিমাণ ১০৫ বিলিয়ন শেকেল (২৭.৬ বিলিয়ন ডলার)। যুদ্ধের খরচ বাড়লে এই লক্ষ্য ধরা রাখা কঠিন হবে।

 

ইরানের অর্থনীতি কতটা টিকবে?
সম্প্রতি ইরানের তেল রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমেছে। বিশ্লেষণী সংস্থা Kpler জানিয়েছে, আগামী রবিবার পর্যন্ত ইরানের মোট অপরিশোধিত তেল ও কনডেনসেট রপ্তানি দৈনিক ১ লাখ ২ হাজার ব্যারেলে নেমে আসবে। অথচ এ বছরের গড় ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ব্যারেল।

 

ইরানের প্রধান রপ্তানি পয়েন্ট খারগ দ্বীপ থেকে একটিও ট্যাংকার গত সোমবার পর্যন্ত ছাড়েনি। দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আংশিক উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, যেখান থেকে ইরানের ৮০ শতাংশ গ্যাস আসে। এছাড়া তেহরানের নিকটবর্তী শহর রে-র শোধনাগার ও জ্বালানি গুদামে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

 

নিষেধাজ্ঞার চাপে ইরান
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের পর ইরানের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে দেশটি যেখানে ২.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি করেছিল, ২০২২-২৩ সালে তা নেমে আসে মাত্র ২ লাখ ব্যারেলে। তেলের রাজস্ব কমে ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

 

চীন এখনো ইরানের তেলের প্রধান ক্রেতা। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান স্বীকার করেছেন, অর্থনৈতিক অবস্থা ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ের চেয়েও খারাপ।

 

ইরানের আরও সংকট
বিদ্যুৎ ও পানির ঘাটতি, দুর্বল অবকাঠামো, রিয়াল মুদ্রার দরপতন এবং বেকারত্ব দেশটির অর্থনীতির বড় সমস্যা। সরকারি হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি ৪০ শতাংশ হলেও, বাস্তবে তা ৫০ শতাংশের বেশি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দারিদ্র্যের হার ২২-২৭ শতাংশ। বেকারত্ব সরকারি হিসেবে ৯.২ শতাংশ হলেও প্রকৃত হার এর চেয়েও বেশি।

 

বাজেটের ৩-৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করে ইরান, যা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের সমান। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য তা যথেষ্ট নয়। সূত্র: আল জাজিরা 

লেখক: আলেক্স কজুল-রাইট

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ব্যবসায়ীকে মারতে মারতে তিনি বললেন ‘আমি ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি, জানস?’

» অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বলছে, নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে হবে: নুর

» ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার ঘটনায় আরও দুই আসামি গ্রেপ্তার

» চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ধরতে এখন থেকেই চিরুনি অভিযান : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

» অগণতান্ত্রিক অপশক্তির প্রধান টার্গেট তারেক রহমান

» প্যারিসের প্রেমের সেতুতে তালা দিলেন মেহজাবীন

» ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে জবির ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে তালা

» শাপলা ছাড়া আমাদের কোনো অপশন নাই : নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী

» ‘শাপলা’ নিয়ে অনড় এনসিপি, প্রতীক তালিকা থেকে ‘নৌকা’ বাদ দেওয়ার দাবি

» তারেক রহমানের সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ স্লোগানের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনারা রাজপথে নামুন: ফজলুর রহমান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

যুদ্ধের খরচে নাজেহাল ইসরায়েল, বিপর্যস্ত অর্থনীতি

অনলাইন ডেস্ক : ইসরায়েল ও ইরান টানা সপ্তম দিনের মতো একে অপরকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনা আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে—এই যুদ্ধে দুই দেশের অর্থনীতি কতদিন টিকে থাকতে পারবে?

 

গত শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন এবং কয়েকটি পরমাণু স্থাপনায় ক্ষতি হয়। পাশাপাশি ইরানের জীবাশ্ম জ্বালানি খাতেও আঘাত হানে তেল আবিব। জবাবে ইরান সরকার ভবন ও ইসরায়েলের মহানগর এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

তবে এই সংঘর্ষ শুধু প্রাণহানি নয়, উভয় দেশের জন্যই আর্থিক দিক থেকে বিরাট ক্ষতি ডেকে আনছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দুই দেশকেই অর্থনৈতিক মন্দা ও বাজেট ঘাটতির মুখোমুখি হতে হবে।

 

ইসরায়েলের যুদ্ধ ব্যয় কত?
গাজায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলমান সামরিক অভিযান ও ইরানের সঙ্গে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘর্ষের কারণে ইসরায়েল ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সময় পার করছে। দেশটির অর্থনৈতিক দৈনিক ‘কালকালিস্ট’ জানিয়েছে, গাজা যুদ্ধেই ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের ২৫০ বিলিয়ন শেকেল (৬৭.৫ বিলিয়ন ডলার) খরচ হয়েছে।

 

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াই নেট’ বলছে, ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষের প্রথম দুই দিনেই খরচ হয়েছে ৫.৫ বিলিয়ন শেকেল (প্রায় ১.৪৫ বিলিয়ন ডলার)। এই হারে চললে, মাত্র সাত সপ্তাহের মধ্যেই ইরান যুদ্ধের ব্যয় গাজা যুদ্ধের ব্যয় ছাড়িয়ে যেতে পারে।

 

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০২৩ সালের ৬০ বিলিয়ন শেকেল (১৭ বিলিয়ন ডলার) থেকে ২০২৪ সালে ৯৯ বিলিয়ন (২৮ বিলিয়ন ডলার) হয়েছে। ২০২৫ সালে তা ১১৮ বিলিয়ন শেকেল (৩৪ বিলিয়ন ডলার) ছুঁতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় জিডিপির ৪.৯ শতাংশ বাজেট ঘাটতির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যার পরিমাণ ১০৫ বিলিয়ন শেকেল (২৭.৬ বিলিয়ন ডলার)। যুদ্ধের খরচ বাড়লে এই লক্ষ্য ধরা রাখা কঠিন হবে।

 

ইরানের অর্থনীতি কতটা টিকবে?
সম্প্রতি ইরানের তেল রপ্তানি ব্যাপকভাবে কমেছে। বিশ্লেষণী সংস্থা Kpler জানিয়েছে, আগামী রবিবার পর্যন্ত ইরানের মোট অপরিশোধিত তেল ও কনডেনসেট রপ্তানি দৈনিক ১ লাখ ২ হাজার ব্যারেলে নেমে আসবে। অথচ এ বছরের গড় ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ব্যারেল।

 

ইরানের প্রধান রপ্তানি পয়েন্ট খারগ দ্বীপ থেকে একটিও ট্যাংকার গত সোমবার পর্যন্ত ছাড়েনি। দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর আংশিক উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, যেখান থেকে ইরানের ৮০ শতাংশ গ্যাস আসে। এছাড়া তেহরানের নিকটবর্তী শহর রে-র শোধনাগার ও জ্বালানি গুদামে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

 

নিষেধাজ্ঞার চাপে ইরান
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহালের পর ইরানের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে দেশটি যেখানে ২.৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি করেছিল, ২০২২-২৩ সালে তা নেমে আসে মাত্র ২ লাখ ব্যারেলে। তেলের রাজস্ব কমে ৫০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।

 

চীন এখনো ইরানের তেলের প্রধান ক্রেতা। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান স্বীকার করেছেন, অর্থনৈতিক অবস্থা ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ের চেয়েও খারাপ।

 

ইরানের আরও সংকট
বিদ্যুৎ ও পানির ঘাটতি, দুর্বল অবকাঠামো, রিয়াল মুদ্রার দরপতন এবং বেকারত্ব দেশটির অর্থনীতির বড় সমস্যা। সরকারি হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি ৪০ শতাংশ হলেও, বাস্তবে তা ৫০ শতাংশের বেশি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দারিদ্র্যের হার ২২-২৭ শতাংশ। বেকারত্ব সরকারি হিসেবে ৯.২ শতাংশ হলেও প্রকৃত হার এর চেয়েও বেশি।

 

বাজেটের ৩-৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করে ইরান, যা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের সমান। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য তা যথেষ্ট নয়। সূত্র: আল জাজিরা 

লেখক: আলেক্স কজুল-রাইট

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com