মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে খাদ্যপণ্য ও ওষুধের কাঁচামাল আমদানির আড়ালে আনা হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি সিগারেট। এতে বিদেশে চলে যাচ্ছে মার্কিন ডলার, যা চলমান ডলার সংকট আরও ঘনীভূত করছে। এতে করে প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি এনবিআরের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমদানি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ সিগারেট। কম নিকোটিনের দোহাই দিয়ে এসব বিদেশি সিগারেট বাজারে ছাড়া হচ্ছে দেদার। এদিকে রাজস্ব ক্ষতির সঙ্গে জনস্বাস্থ্যও চরম হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা মহামারির পর বিদেশি সিগারেট আমদানি কয়েক গুণ বেড়েছে বলে জানা গেছে। অর্থ বিভাগের এক মূল্যায়নপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ জন্য এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগকে আরও তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগের পৃথক পত্র ঘেঁটে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসা অবৈধ বিদেশি সিগারেট। শহরের অলিগলি থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেদার বিক্রি হচ্ছে এসব সিগারেট। কম মূল্য, আকর্ষণীয় মোড়ক, ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভার ও সহজলভ্য হওয়ায় তরুণ প্রজন্মের ধূমপায়ীরা ঝুঁকছেন এসব সিগারেটে। এতে একদিকে বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, অন্যদিকে মিথ্যা ঘোষণায় দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে বড় অঙ্কের অর্থ। সেই সঙ্গে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
নামে প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের একটি প্রতিবেদন পেয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা সেলও এটা নিয়ে কাজ করছে।’ অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ বিদেশি সিগারেটের দৌরাত্ম্যে সরকারের চলতি অর্থবছর গত অর্থবছরের তুলনায় তামাক খাত থেকে আশঙ্কাজনক হারে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অতি উচ্চস্তর ও উচ্চস্তরের সিগারেট থেকে রাজস্ব আয় কমেছে ৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির ধারা অনুযায়ী, বছরের বাকি ছয় মাসে এটা আরও বাড়বে। এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ যে সিগারেট আসছে তাতে করে সরকার শুধু চলতি অর্থবছরই অন্তত ৮০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাবে বলে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের এক চিঠিতে জানানো হয়েছে।
এনবিআরের এক প্রতিবেদনের তথ্য ঘেঁটে জানা যায়, চট্টগ্রাম সমুদ্র ও বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন বন্দর দিয়ে শক্তিশালী চক্র মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিদেশি সিগারেট দেশে নিয়ে আসছে। চোরাকারবারিরা ফ্ল্যাট, বাসা ভাড়া নিয়ে মজুদ করছে এসব সিগারেট। পরে বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়ে তা সারা দেশের পাইকারি, মাঝারি ও ক্ষুদ্র দোকানিদের কাছে বিক্রি করছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, শুধু চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে গত দুই বছরে অবৈধভাবে আসা প্রায় ৯০ কোটি শলাকা বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট জব্দ করা হয়েছে। এগুলোর মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে সবচেয়ে বেশি এসেছে ‘ওরিস’ ব্র্যান্ডের সিগারেট। এ ছাড়া রয়েছে ইজি লাইট, ইজি গোল্ড, মন্ড, ডানহিলসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট। বাজারে শুধুমাত্র ওরিস ব্র্যান্ডের সিগারেট রয়েছে অন্তত ১২ ফ্লেভারের। শুল্ক গোয়েন্দাদের জালে ইতোমধ্যে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অবৈধভাবে বিদেশি সিগারেট আমদানির সঙ্গে জড়িত কিছু প্রতিষ্ঠানের নামও উঠে এসেছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মিথ্যা ঘোষণায় বিভিন্ন জরুরি পণ্যের আড়ালে অবৈধভাবে নিয়ে আসা এসব অবৈধ বিদেশি সিগারেটের কারণে সরকার শুধু রাজস্বই হারাচ্ছে না, এর মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার করা হচ্ছে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। এর জন্য সরকারের তদারকি ও যথাযথ আইনি পদক্ষেপের অভাবকেই দায়ী করছেন তারা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত হবে এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি বাড়ানো। জানা গেছে, বৈধভাবে সিগারেট আমদানি করতে ৬০২ শতাংশ বিভিন্ন রাজস্ব পরিশোধ করতে হয়। এতে করে বিদেশি সিগারেটের প্রতি শলাকার দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। দাম বেশি হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভোক্তারাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাই একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধ পন্থায় মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে এসব সিগারেট আমদানি করে অনেক কম দামে বাজারে বিক্রি করছে। আর হুন্ডি হয়ে চলে যাচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ বাংলাদেশে বছরখানেক ধরেই চলছে ডলারের তীব্র সংকট।
স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস ও রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার প্রতি বছর সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি করে আসছে। গত পাঁচ বছরে সিগারেটের দাম দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১০-২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সিগারেটের ভোক্তা ৯.৩ শতাংশ কমেছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, পৃথিবীর অন্তত ৫৮টি দেশে বাংলাদেশের চেয়ে কম মূল্যে সিগারেট বিক্রি হয়। এসব দেশ থেকে কয়েক বছর ধরে অবৈধ বিদেশি সিগারেট ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। দেশীয় একই স্তরের সিগারেটের থেকে প্রায় অর্ধেক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে এসব সিগারেট। যেখানে বেনসনের ২০ শলাকা প্যাকেটের মূল্য ৩২০ টাকা সেখানে ওরিস ব্র্যান্ডের সিগারেট ২০ শলাকা প্যাকেট পাওয়া যাচ্ছে ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। গত বাজেটে অতি উচ্চ স্তরের সিগারেটের দাম বেড়ে যাওয়ায় তুলনামূলক সস্তা বিকল্প হিসেবেও এসব সিগারেট জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, যা অবৈধভাবে আমদানি করা। অথচ সরকার এ কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে প্রতি বছর।
সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন