নেতৃত্বের ভাবনা: যোগ্যতার যাচাই কতটা হবে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে?

 বাণী ইয়াসমিন হাসি :কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন মুখ নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ। নেতৃত্ব নির্বাচনে ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২২তম জাতীয় সম্মেলন বা কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।

 

২৮ অক্টোবর বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবারে আয়োজন সাদামাটা হবে জানিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতায় ব্যয় কমাতে হবে। খরচ কমানোর জন্য আয়োজন হবে সাদামাটা। এবারের  জাতীয় সম্মেলন একদিনেই সম্পন্ন করা হবে। দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সকালে উদ্বোধন পর্ব, বিকেলে কাউন্সিল অধিবেশন হবে- অর্থাৎ নেতৃত্ব নির্বাচন পর্ব।

 

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রাজধানীর রোজ গার্ডেনে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্ম। ঐতিহ্যবাহী এই দলটির বয়স ৭৩ বছর। এ পর্যন্ত দলটির ২১টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

 

দেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এবার আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যারা দায়িত্ব পাবেন, এই নেতৃত্বকে নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধীদল বিএনপি ততই মরিয়া হয়ে রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করবে এবং নির্বাচনে অংশ নেবে। সেকারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ঘটনাবহুল হতে পারে। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আসবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।

 

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েছে। বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলোর দূর্বলতা এবং কোন্দল নিয়েও আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।

 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলকে পরিচালনা বা ঐক্যবদ্ধ রাখা- এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনার অগ্রাধিকারে থাকবে। কারণ প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতাকর্মীরা সারাদেশেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেখানে আওয়ামী লীগকে তাদের ঘর গোছাতে হবে। আওয়ামী লীগকেও একটা বড় দল হিসাবে মাঠে শক্তির পরিচয় দিতে হবে এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। সেখানে সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের দিকে পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশের নজর থাকে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা নাক গলান এমন অভিযোগও রয়েছে। ফলে বড় একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে কে আসছেন, সেদিকেও বিদেশিদের নজর থাকে। কূটনীতিকদের সাথে আলোচনা এবং আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে দলের প্রতিনিধিত্ব করতে হয় সাধারণ সম্পাদককে। ফলে এই বিষয়টিও সাধারণ সম্পাদক পদের ক্ষেত্রে বড় বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সাহস, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং ত্যাগী-এসব বিষয় বিবেচনা করে দলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হবে।

 

জাতীয় কাউন্সিলের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলাসহ উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের সম্মেলন সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা ও ৬৫০ সাংগঠনিক উপজেলা রয়েছে। সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে ৫০টি ও পাঁচ শতাধিক উপজেলার সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবি, জাতীয় সম্মেলনের আগেই সব জেলা-উপজেলা শাখায় সম্মেলন সম্পন্ন হবে। যেসব জেলায় সম্মেলন এখনো হয়নি, সেগুলোর সম্মেলন তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগেই সম্মেলন সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।

 

আহমদ ছফা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হলে লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ জিতলে একা জিতে আর হারলে পুরো দেশ হারে’। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে বোঝা যায় একজন নেতা হতে হলে কত বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে হয়। বঙ্গবন্ধু বা তাঁর সহকর্মীদের নেতা হয়ে ওঠার কাহিনি প্রায় একই রকম। তাঁরা কেউ নেতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। জনমানুষের প্রতি অঙ্গীকার, পরিশ্রম, ত্যাগ, নির্লোভ চরিত্র তাদের নেতা বানিয়েছে। সকলে কর্মী থেকে কর্মগুণে নেতা হয়েছেন। জনমানুষের প্রত্যাশা ও ভালোবাসার প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করতে গিয়ে তাদের অনেকে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু কখনও কোনো পদ পদবির জন্য লালায়িত ছিলেন না।

 

এখন কেউ আর কর্মী হতে রাজি নন। সকলে নেতা হয়ে দলে প্রবেশ করেন। দলে এখন একশ্রেণির মৌসুমি নেতানেত্রী আর কর্মীর আবির্ভাব, যাদের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতির কখনও কোনো সম্পর্ক ছিল না।  সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি আদর্শের নাম, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম।’ বর্তমানে হঠাৎ করে যারা আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী বনে গিয়েছেন তাদের ক’জন এই আদর্শ আর অনুভূতি ধারণ করেন?

 

বঙ্গবন্ধুর সেই আওয়ামী লীগ কি এখন আছে? সহজ উত্তর, না নেই। ক্ষমতা, লোভ ও অহংকারের কাছে হারিয়ে গেছে, আর তাতে অবদান রেখেছে নব্য আওয়ামী লীগার বা হাইব্রিডরা। এখন আওয়ামী লীগ করতে বঙ্গবন্ধুর বা আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার থাকার প্রয়োজন নেই। কোনও এক বড় ভাই বা হাইব্রিড নেতার আশীর্বাদই যথেষ্ট। উত্তরাধিকার সূত্রেও হওয়া যায়। পিতা একজন নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন। সন্তান ‘আই হেট পলিটিক্স জেনারেশনের’। সমস্যা নেই। ক’দিন পর দেখা গেল তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।

 

পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায় অমুক জেলার বা উপজেলার রাজাকারের সন্তান, জামায়াত বিএনপি’র নেতানেত্রীরা দলের বিভিন্ন পদ পদবি বাগিয়ে নিচ্ছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, আর দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত কর্মীরা তা নীরবে তাকিয়ে দেখছেন। এক-এগারোর পর যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে গ্রেফতার করা হলো তখন এত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কোথায় ছিল?

 

আওয়ামী লীগে এখন অসংখ্য উইপোকা ঢুকেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা অনেক চেষ্টা করছেন ঘর পরিষ্কার করতে। কিন্তু পেরে উঠছেন বলে মনে হয় না। এই উইপোকাগুলো শুধু যে দলকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা নয়, তাদের কারণে সরকারের কত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অনেক হাইব্রিডের লাগামহীনভাবে পদায়ন হচ্ছে। বাজারে একটা কথা এখন খুব চালু আছে আর তা হচ্ছে এই মুহূর্তে দেশে পদপদবি আর পদক সবকিছুই নিলামে চড়েছে।

 

কাউন্সিল উপলক্ষ্যে জেলা/ উপজেলায় সাজসাজ রব। ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড তোরণে ছেয়ে যায় গোটা এলাকা। এক এক জেলায় সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী থাকেন ডজন খানেক। প্রচারণা, শোডাউন, কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করা সবমিলিয়ে একটা বড় বাজেট। আমার প্রশ্ন হলো আগের কমিটিই যদি বহাল রাখা হয়, তাহলে এমন অপচয়ের কি দরকার? কেন্দ্র থেকে প্রেসরিলিজের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করে দিলেই তো হয়। লাখ লাখ, কোথাওবা কোটির উপরে খরচ করে তৃণমূলের নেতারা নিঃস্ব হচ্ছেন। দিনশেষে খালি হাতে ঘরে ফিরছেন। অধিকাংশ জেলা উপজেলায় শুধু সভাপতি সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। কমিটিটা যদি একটু বড় পরিসরে করা হয় তাহলেও তো অন্তত কিছু ত্যাগী পরীক্ষিতদেরকে একটা সম্মানজনক জায়গা করে দেওয়া যায়?

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট ও পরিচালক, জাগরণ টিভি।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» জুলাই-আগস্টের চেতনা হারিয়ে যাচ্ছে: উপদেষ্টা নাহিদ

» পূজায় অপ্রীতিকর ঘটনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে: আইজিপি

» সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ : ইশরাক

» ধর্মের উপর আঘাত সহ্য করা হবে না

» কুচক্রী মহলের হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে : র‍্যাব মহাপরিচালক

» গণহত্যার বিচার শুরু হলে অনেক দ্বিধা-প্রশ্ন দূর হবে : আসিফ নজরুল

» ১৩ অক্টোবর থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা

» মঙ্গলবার ফল প্রকাশ যেভাবে জানবেন এইচএসসি ও সমমানের রেজাল্ট

» জামালপুরে সেফটিক ট্যাংক থেকে নৈশ্যপ্রহরীর মরদেহ উদ্ধার

» এভারকেয়ার হসপিটালে কালেকশন সার্ভিস দেবে ব্র্যাক ব্যাংক

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

নেতৃত্বের ভাবনা: যোগ্যতার যাচাই কতটা হবে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে?

 বাণী ইয়াসমিন হাসি :কেন্দ্রীয় কমিটিতে নতুন মুখ নিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ। নেতৃত্ব নির্বাচনে ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২২তম জাতীয় সম্মেলন বা কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।

 

২৮ অক্টোবর বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবারে আয়োজন সাদামাটা হবে জানিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের কারণে ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতায় ব্যয় কমাতে হবে। খরচ কমানোর জন্য আয়োজন হবে সাদামাটা। এবারের  জাতীয় সম্মেলন একদিনেই সম্পন্ন করা হবে। দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সকালে উদ্বোধন পর্ব, বিকেলে কাউন্সিল অধিবেশন হবে- অর্থাৎ নেতৃত্ব নির্বাচন পর্ব।

 

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রাজধানীর রোজ গার্ডেনে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্ম। ঐতিহ্যবাহী এই দলটির বয়স ৭৩ বছর। এ পর্যন্ত দলটির ২১টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

 

দেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এবার আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যারা দায়িত্ব পাবেন, এই নেতৃত্বকে নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। সংসদ নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বিরোধীদল বিএনপি ততই মরিয়া হয়ে রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করবে এবং নির্বাচনে অংশ নেবে। সেকারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতি ঘটনাবহুল হতে পারে। সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আসবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।

 

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়েছে। বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনগুলোর দূর্বলতা এবং কোন্দল নিয়েও আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।

 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলকে পরিচালনা বা ঐক্যবদ্ধ রাখা- এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনার অগ্রাধিকারে থাকবে। কারণ প্রতিপক্ষ বিএনপির নেতাকর্মীরা সারাদেশেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেখানে আওয়ামী লীগকে তাদের ঘর গোছাতে হবে। আওয়ামী লীগকেও একটা বড় দল হিসাবে মাঠে শক্তির পরিচয় দিতে হবে এবং নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। সেখানে সাধারণ সম্পাদকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের দিকে পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশের নজর থাকে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা নাক গলান এমন অভিযোগও রয়েছে। ফলে বড় একটি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে কে আসছেন, সেদিকেও বিদেশিদের নজর থাকে। কূটনীতিকদের সাথে আলোচনা এবং আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে দলের প্রতিনিধিত্ব করতে হয় সাধারণ সম্পাদককে। ফলে এই বিষয়টিও সাধারণ সম্পাদক পদের ক্ষেত্রে বড় বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সাহস, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এবং ত্যাগী-এসব বিষয় বিবেচনা করে দলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হবে।

 

জাতীয় কাউন্সিলের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলাসহ উপজেলা, থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের সম্মেলন সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। আওয়ামী লীগের ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা ও ৬৫০ সাংগঠনিক উপজেলা রয়েছে। সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে ৫০টি ও পাঁচ শতাধিক উপজেলার সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের দাবি, জাতীয় সম্মেলনের আগেই সব জেলা-উপজেলা শাখায় সম্মেলন সম্পন্ন হবে। যেসব জেলায় সম্মেলন এখনো হয়নি, সেগুলোর সম্মেলন তারিখ চূড়ান্ত হয়েছে। আগামী জাতীয় সম্মেলনের আগেই সম্মেলন সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।

 

আহমদ ছফা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিজয়ী হলে লিখেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ জিতলে একা জিতে আর হারলে পুরো দেশ হারে’। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে বোঝা যায় একজন নেতা হতে হলে কত বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে হয়। বঙ্গবন্ধু বা তাঁর সহকর্মীদের নেতা হয়ে ওঠার কাহিনি প্রায় একই রকম। তাঁরা কেউ নেতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। জনমানুষের প্রতি অঙ্গীকার, পরিশ্রম, ত্যাগ, নির্লোভ চরিত্র তাদের নেতা বানিয়েছে। সকলে কর্মী থেকে কর্মগুণে নেতা হয়েছেন। জনমানুষের প্রত্যাশা ও ভালোবাসার প্রতি অঙ্গীকার রক্ষা করতে গিয়ে তাদের অনেকে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যার ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু কখনও কোনো পদ পদবির জন্য লালায়িত ছিলেন না।

 

এখন কেউ আর কর্মী হতে রাজি নন। সকলে নেতা হয়ে দলে প্রবেশ করেন। দলে এখন একশ্রেণির মৌসুমি নেতানেত্রী আর কর্মীর আবির্ভাব, যাদের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতির কখনও কোনো সম্পর্ক ছিল না।  সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি আদর্শের নাম, আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম।’ বর্তমানে হঠাৎ করে যারা আওয়ামী লীগের নেতানেত্রী বনে গিয়েছেন তাদের ক’জন এই আদর্শ আর অনুভূতি ধারণ করেন?

 

বঙ্গবন্ধুর সেই আওয়ামী লীগ কি এখন আছে? সহজ উত্তর, না নেই। ক্ষমতা, লোভ ও অহংকারের কাছে হারিয়ে গেছে, আর তাতে অবদান রেখেছে নব্য আওয়ামী লীগার বা হাইব্রিডরা। এখন আওয়ামী লীগ করতে বঙ্গবন্ধুর বা আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার থাকার প্রয়োজন নেই। কোনও এক বড় ভাই বা হাইব্রিড নেতার আশীর্বাদই যথেষ্ট। উত্তরাধিকার সূত্রেও হওয়া যায়। পিতা একজন নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন। সন্তান ‘আই হেট পলিটিক্স জেনারেশনের’। সমস্যা নেই। ক’দিন পর দেখা গেল তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন।

 

পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায় অমুক জেলার বা উপজেলার রাজাকারের সন্তান, জামায়াত বিএনপি’র নেতানেত্রীরা দলের বিভিন্ন পদ পদবি বাগিয়ে নিচ্ছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, আর দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত কর্মীরা তা নীরবে তাকিয়ে দেখছেন। এক-এগারোর পর যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে গ্রেফতার করা হলো তখন এত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কোথায় ছিল?

 

আওয়ামী লীগে এখন অসংখ্য উইপোকা ঢুকেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা অনেক চেষ্টা করছেন ঘর পরিষ্কার করতে। কিন্তু পেরে উঠছেন বলে মনে হয় না। এই উইপোকাগুলো শুধু যে দলকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা নয়, তাদের কারণে সরকারের কত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অনেক হাইব্রিডের লাগামহীনভাবে পদায়ন হচ্ছে। বাজারে একটা কথা এখন খুব চালু আছে আর তা হচ্ছে এই মুহূর্তে দেশে পদপদবি আর পদক সবকিছুই নিলামে চড়েছে।

 

কাউন্সিল উপলক্ষ্যে জেলা/ উপজেলায় সাজসাজ রব। ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড তোরণে ছেয়ে যায় গোটা এলাকা। এক এক জেলায় সভাপতি সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী থাকেন ডজন খানেক। প্রচারণা, শোডাউন, কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করা সবমিলিয়ে একটা বড় বাজেট। আমার প্রশ্ন হলো আগের কমিটিই যদি বহাল রাখা হয়, তাহলে এমন অপচয়ের কি দরকার? কেন্দ্র থেকে প্রেসরিলিজের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করে দিলেই তো হয়। লাখ লাখ, কোথাওবা কোটির উপরে খরচ করে তৃণমূলের নেতারা নিঃস্ব হচ্ছেন। দিনশেষে খালি হাতে ঘরে ফিরছেন। অধিকাংশ জেলা উপজেলায় শুধু সভাপতি সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। কমিটিটা যদি একটু বড় পরিসরে করা হয় তাহলেও তো অন্তত কিছু ত্যাগী পরীক্ষিতদেরকে একটা সম্মানজনক জায়গা করে দেওয়া যায়?

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট ও পরিচালক, জাগরণ টিভি।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com