নব দিগন্ত

সুপ্রিয়া প্রিয়া জ্যোতি:শোভাবাজার রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব। বহু চেষ্টা করেও ছেলেপুলের মুখ না দেখায় সিদ্ধান্ত নিলেন পুত্রসন্তান দত্তক নেবেন। আর তাই উচ্চ ব্রাহ্মণ ঘর থেকে আনলেন এক পুত্র সন্তান, সে দত্তকপুত্রের নাম দিলেন গোপীমোহন দেব। নবকৃষ্ণ দেব তার এই রাজবাড়ীর রাস্তাটা নিজের নামে নামকরণ করেন নবকৃষ্ণ স্ট্রিট নামে। আর অনেক বড়ো করে নিজের বাড়িতেই দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। ফিবছর রাজবাড়ীজুড়ে মহাধুমধামে চলে দুর্গাপূজা।রাজবাড়ীর সামনের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের পিতামহ এবং রাজবাড়ীর এই সব কথাই ভাবছিলেন গোপীমোহন দেবের জ্যেষ্ঠপুত্র রামাকান্ত দেব।

যিনি এই রাজবাড়ীর ভাবি রাজা।

আজ বিজয়া দশমী। বাড়ির বউ-ঝিরা এখন সিঁদুর খেলায় মেতেছে। চারদিকে ধূপধুনোর গন্ধ, ঢাকের বাদ্য, সিঁদুরের ছড়াছড়ি আর খানিক বাদে বাদে উলুধ্বনি বাজছে। রামাকান্তের সেদিকে মনোযোগ নেই। সে কিছুদিন হয় জানতে পেরেছে তার পিতামহ নবকৃষ্ণ তার বাবাকে দত্তক নিয়েছিলেন। নিজের বংশ এবং পৌরুষ্য নিয়ে বরাবরই অহংকারী রামাকান্ত দেবের। এ ঘটনা জানার পর তার সামান্য খারাপ লাগলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এখন তার মনোযোগ বারান্দার শেষ মাথায়। সাদাকালো রঙের দাবার কোটের মতো মেঝের ওপর উবু হয়ে মেঝে পরিষ্কার করছে এক নারী। ছিপছিপে দেহ, চিকন কোমর থেকে কিছুটা কাপড় সরে আছে, উদাম পিঠের দিকে তাকাতেই রামকান্ত দেখলো বাদামি রঙের মসৃণ শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পিছন থেকে দেখেই সে একবার এই নারীর মুখখানা দেখার জন্য দরাজ কন্ঠে হাঁক দিল – কে ওখানে?

দাসী ইতস্তত হয়ে উঠে শরীরে কাপড় টেনে দুইহাত বুকের সামনে কোরজোড়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-আমি বাবু, মাঠাকুরুণ বললেন দোতলার মেঝে, সিঁড়ি পরিষ্কার করতে। তাই…

-নাম কী?

-লছমী

-কবে আনা হয়েছে?

-বাবু,দিন দশেক হবে।

-আচ্ছা,যেতে পারো।

রামাকান্ত লছমী চলে যাওয়ার দৃশ্যটা অপলকভাবে দেখছে আর মন মস্তিষ্কে গেঁথে

রাখছে।

 

২.

দেবী বিসর্জন শেষ। পুরো রাজবাড়ী শুনশান নীরব। সবাই এখন গভীর ঘুমে। রামাকান্ত ভাবছে লছমীর কথা। বয়স কত হবে ষোল-সতের। ঠিক নারী বলে মনে হয় না। তবে শরীর বেয়ে যৌবন যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। ঘামে ভেজা শাড়ি লেপটে ছিল বুকের ওপর। যখন হাত জোড় করে নমস্কার করছিল তখনই চোখ গেছে ওর ভরাট বুকে। বাকানো ভ্রু, টানা চোখ, পুরু ঠোঁট সব মিলেয়ে একটা গজ গজ ভাব আছে মেয়েটার মধ্যে। রাতের নিস্তব্ধতা, ফুলের ঘ্রাণ, মৃদুমন্দ হাওয়া রামাকান্তকে আরো বেশি মাতোয়ারা করে দিচ্ছিল লছমীকে কাছে পাওয়ার জন্য।

তার এই আকুতি যে এই প্রথম তা কিন্তু নয়। এই ২৬ বছরের জীবনে বহু নারী শরীর নিয়ে সে খেলেছে। প্রেমভাব কারো জন্যে হয়নি। কিন্তু এই একজন নারী এক লামহায় যেন তার শরীর মন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

 

৩.

সেদিন সন্ধ্যার মুখে বাড়ির সবাই যখন যার যার কাজে ব্যস্ত। লছমী সন্তর্নে উঠে এসেছে রাজবাড়ীর দক্ষিণের ঘরের বারান্দায়। রামাকান্তের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। অন্ধকারে টুপ করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রামাকান্ত আগে থেকেই প্রস্তুত। তাদের কখন, কোথায়, কীভাবে দেখা হবে তা সে আগে থেকেই ঠিক করে। আর লছমীও সুবোধ বালিকার মতো সেভাবেই কাজ করে। ঘরে প্রবেশ করতেই রামাকান্ত লছমীকে জড়িয়ে ধরে। অন্ধকারে কেউ কারো দৃষ্টি দেখতে পায় না। রামাকান্ত লছমীর ঘাড়ে হাত রেখে কাছে টানে। দুজনের নিশ্বাসের উত্তাপ দুজনের মুখের ওপর আছড়ে পড়ে। অন্ধকারে দুজন মানব মানবী একে অপরকে গ্রহণ করে। তাদের উপস্থিতি স্পর্শে। লছমীর কাছে মনে হয় এ অন্য এক জগৎ। রাজবাড়ীতে তার অবস্থান আর রামাকান্তের অবস্থান যে আকাশ- পাতাল সেসব কিছুই তার মনে থাকে না। এক অদ্ভুত মাদকতা কাজ করে শরীরে, মনে।

রামাকান্ত তাকে সত্যি ভালোবাসে কি না সে জানে না। কিন্তু বিগত তিন মাসে তার সাথে যা যা হয়েছে তাতে করে সে রামাকান্তকে ভালোবেসে ফেলেছে। এটা যে অন্যায়, এটা যে পাপ সেটা খুব ভালো করে জানে লছমী। কিন্তু বাবু তাকে ডাকলে সে নিজেকে কিছুতেই সংবরণ করতে পারে না।

গত মাসে তার রজঃস্রাবের দিন চলে গেছে। এ মাসেও ৮ দিন যাচ্ছে। লছমী বাবুকে বলবে কি না ভাবছে।

– চুপ করে কী ভাবছো?

– বাবু আমার মাসিক বন্ধ।

-সেকি! কবে থেকে?

– গত মাসের পূর্ণিমার সময় হয়েছিল এখন অবধি হয়নি।

-আরে পূর্ণিমা মানে? ঠিক করে বলো!

লছমী আঙুলে হিসাব কষে বললো-আটচল্লিশ দিন হবে বাবু।

রামাকান্ত প্রচন্ড রেগে গেলেও খুব শান্তভাবে বললো

– করেছ কী তুমি? আগে বলোনি কেন? আর কাউকে জানিয়েছ?

– না

-শোন যা বলি সেটা করো। তোমার বাড়িতে কে আছেন।

– শুধু মা। বাবা ফেলে চলে গেছেন। আর ভাই মারা গেছে কলেরায়।

-আচ্ছা আচ্ছা, এত কিছু জানতে চাইনি। তুমি তোমার মায়ের কাছে চলে যাও। আমি তোমাকে খরচ যত প্রয়োজন দিয়ে দিবো। এই ঘটনা কাউকে বলো না।

কিছুদিন পরেই আমি হবো এই শোভাবাজারের একমাত্র রাজা। তখন আমি তোমাকে এখানে নিয়ে আসব। ততোদিন তুমি চুপ থাকবে।

লাছমী অঝোরে কাঁদছে।

রামাকান্ত লছমীকে বুকে জড়িয়ে, কপালে চুমু খেয়ে শান্ত করে বলে। লক্ষ্মী মেয়ে এসব যেন কেউ টের না পায়। আমার মঙ্গল হোক তা নিশ্চয়ই চাও?

কান্না জড়িত কন্ঠে শুধু বললো- হ্যাঁ চাই।

 

৪.

আজ লছমীর বিচারের দিন। রাজ দরবারের সিংহাসনে বসে আছেন নবকৃষ্ণ দেব। লছমীর অপরাধ সে ভ্রষ্টাচারী নারী এবং তার ভূমিষ্ঠ মৃত সন্তানকে লুকানোর চেষ্টা করেছে।

লছমী যখন বলে এই সন্তানের বাবা শোভাবাজারের ভাবি রাজা রামাকান্ত দেব। তখনই রাজ দরবারে গুঞ্জন শুরু হয় এবং রামাকান্তের পক্ষ হয়ে ব্রাহ্মণগণ বলেন-

” ব্রাহ্মণদের যে আইন আছে তার মধ্যে বলা আছে যে, ব্রাহ্মণ নিম্নবর্গের স্ত্রীলোকের সাথে যেকোনো ধরনের মেলামেশা করতে পারবে। এমনকি তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে সংসর্গ দোষ ছাড়া অন্য কোনো নৈতিক অপরাধ হবে না”।

এতে সমর্থন যুগিয়েছে সভাসদগণ। তাদের কথা আমরা কুলিন ব্রাহ্মণ। আমরা যা সিদ্ধান্ত নিবো তা সকলের মঙ্গলের জন্য।

এবং সেখানে লছমীকে সকল রূপে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

লাছমী কিছুই বলে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দরবারের কোনায় জড়সড় হয়ে বসে থাকা রামাকান্তের দিকে। আর পুরোনো স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে থাকে। কি ভিষণ রকম ভালোই না বেসেছিল এই পাষন্ড মানুষটাকে।

পরের শনিবার ভোরে ফাঁসির সময় ধার্য করা হয়। গ্রাম থেকে মেয়ের সাথে শেষ দেখা করতে ছুটে আসেন লছমীর মা।

মেয়েকে বুকে নিয়ে তার মা বারবার বলতে থাকে এত কিছু ঘটে গেল কেন ফিরে গেলি না।

লাছমী তখন নীরব পাথর। কোনো কথা বলছে না। শুধু বললো ভালোবেসে ভুল করেছি মা।

 

৫.

সব কিছু ঠিকঠাক। ফাঁসিকাষ্ঠ তৈরি। লছমীকে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে তোলা হলো ফাঁসিকাষ্ঠে। দুজন জল্লাদের তত্তাবধানে ফাঁসির কাজ শেষ হলো। লছমীকে যখন নামানো হলো সে মৃত কি না তা পরীক্ষার জন্য তখন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দেখা গেলো লছমীর হৃদস্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। দু-তিনজন মিলে পরীক্ষা করলো। দেখলো সত্যি সে মারা যায়নি। কিন্তু জ্ঞানও ফিরছে না। তখন এক কবিরাজ এসে তার নাকে তামাকের ধোঁয়া দিতেই নড়েচড়ে উঠল।

আর এই বিরল ঘটনা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট হয়ে পুরো শোভাবাজার ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল।

সবাই বলাবলি করতে লাগলো –

লাছমী ভগবানের চোখে নির্দোষ তাই স্বয়ং ভগবান ওকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

সূএ:ঢাকাটাইম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» শহীদদের নিয়ে মামলার নামে দেশে ব্যবসা শুরু হয়েছে: সারজিস

» ‘কাদের আমার বাসায় আসতে চেয়েছিলেন, আজ তিনি কোথায়?’

» ‘আগামীতে সরকার-বিরোধী দলকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে’

» ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন ব্যাগের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী অভিযান: উপদেষ্টা রিজওয়ানা

» বাসায় ফিরেছেন খালেদা জিয়া

» মতিঝিল রুটে চললো মেট্রো ট্রেন

» দেশে প্রথমবারের মতো আর্মরশেল প্রটেকশনের ফোন নোট ৬০ এনেছে রিয়েলমি

» স্যামসাং উইন্ডফ্রি এসি এক্সপেরিয়েন্স জোন: ভবিষ্যতের এক ঝলক

» সুন্দরবনের উপকূলীয় বাগেরহাটের নয় উপজেলায় আখের বাম্পার ফলন, চাষিরমুখে হাসির ঝিলিক

» অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম একনেকে ৪ প্রকল্প অনুমোদন

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

নব দিগন্ত

সুপ্রিয়া প্রিয়া জ্যোতি:শোভাবাজার রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেব। বহু চেষ্টা করেও ছেলেপুলের মুখ না দেখায় সিদ্ধান্ত নিলেন পুত্রসন্তান দত্তক নেবেন। আর তাই উচ্চ ব্রাহ্মণ ঘর থেকে আনলেন এক পুত্র সন্তান, সে দত্তকপুত্রের নাম দিলেন গোপীমোহন দেব। নবকৃষ্ণ দেব তার এই রাজবাড়ীর রাস্তাটা নিজের নামে নামকরণ করেন নবকৃষ্ণ স্ট্রিট নামে। আর অনেক বড়ো করে নিজের বাড়িতেই দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। ফিবছর রাজবাড়ীজুড়ে মহাধুমধামে চলে দুর্গাপূজা।রাজবাড়ীর সামনের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের পিতামহ এবং রাজবাড়ীর এই সব কথাই ভাবছিলেন গোপীমোহন দেবের জ্যেষ্ঠপুত্র রামাকান্ত দেব।

যিনি এই রাজবাড়ীর ভাবি রাজা।

আজ বিজয়া দশমী। বাড়ির বউ-ঝিরা এখন সিঁদুর খেলায় মেতেছে। চারদিকে ধূপধুনোর গন্ধ, ঢাকের বাদ্য, সিঁদুরের ছড়াছড়ি আর খানিক বাদে বাদে উলুধ্বনি বাজছে। রামাকান্তের সেদিকে মনোযোগ নেই। সে কিছুদিন হয় জানতে পেরেছে তার পিতামহ নবকৃষ্ণ তার বাবাকে দত্তক নিয়েছিলেন। নিজের বংশ এবং পৌরুষ্য নিয়ে বরাবরই অহংকারী রামাকান্ত দেবের। এ ঘটনা জানার পর তার সামান্য খারাপ লাগলেও সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এখন তার মনোযোগ বারান্দার শেষ মাথায়। সাদাকালো রঙের দাবার কোটের মতো মেঝের ওপর উবু হয়ে মেঝে পরিষ্কার করছে এক নারী। ছিপছিপে দেহ, চিকন কোমর থেকে কিছুটা কাপড় সরে আছে, উদাম পিঠের দিকে তাকাতেই রামকান্ত দেখলো বাদামি রঙের মসৃণ শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম। পিছন থেকে দেখেই সে একবার এই নারীর মুখখানা দেখার জন্য দরাজ কন্ঠে হাঁক দিল – কে ওখানে?

দাসী ইতস্তত হয়ে উঠে শরীরে কাপড় টেনে দুইহাত বুকের সামনে কোরজোড়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-আমি বাবু, মাঠাকুরুণ বললেন দোতলার মেঝে, সিঁড়ি পরিষ্কার করতে। তাই…

-নাম কী?

-লছমী

-কবে আনা হয়েছে?

-বাবু,দিন দশেক হবে।

-আচ্ছা,যেতে পারো।

রামাকান্ত লছমী চলে যাওয়ার দৃশ্যটা অপলকভাবে দেখছে আর মন মস্তিষ্কে গেঁথে

রাখছে।

 

২.

দেবী বিসর্জন শেষ। পুরো রাজবাড়ী শুনশান নীরব। সবাই এখন গভীর ঘুমে। রামাকান্ত ভাবছে লছমীর কথা। বয়স কত হবে ষোল-সতের। ঠিক নারী বলে মনে হয় না। তবে শরীর বেয়ে যৌবন যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। ঘামে ভেজা শাড়ি লেপটে ছিল বুকের ওপর। যখন হাত জোড় করে নমস্কার করছিল তখনই চোখ গেছে ওর ভরাট বুকে। বাকানো ভ্রু, টানা চোখ, পুরু ঠোঁট সব মিলেয়ে একটা গজ গজ ভাব আছে মেয়েটার মধ্যে। রাতের নিস্তব্ধতা, ফুলের ঘ্রাণ, মৃদুমন্দ হাওয়া রামাকান্তকে আরো বেশি মাতোয়ারা করে দিচ্ছিল লছমীকে কাছে পাওয়ার জন্য।

তার এই আকুতি যে এই প্রথম তা কিন্তু নয়। এই ২৬ বছরের জীবনে বহু নারী শরীর নিয়ে সে খেলেছে। প্রেমভাব কারো জন্যে হয়নি। কিন্তু এই একজন নারী এক লামহায় যেন তার শরীর মন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।

 

৩.

সেদিন সন্ধ্যার মুখে বাড়ির সবাই যখন যার যার কাজে ব্যস্ত। লছমী সন্তর্নে উঠে এসেছে রাজবাড়ীর দক্ষিণের ঘরের বারান্দায়। রামাকান্তের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। অন্ধকারে টুপ করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রামাকান্ত আগে থেকেই প্রস্তুত। তাদের কখন, কোথায়, কীভাবে দেখা হবে তা সে আগে থেকেই ঠিক করে। আর লছমীও সুবোধ বালিকার মতো সেভাবেই কাজ করে। ঘরে প্রবেশ করতেই রামাকান্ত লছমীকে জড়িয়ে ধরে। অন্ধকারে কেউ কারো দৃষ্টি দেখতে পায় না। রামাকান্ত লছমীর ঘাড়ে হাত রেখে কাছে টানে। দুজনের নিশ্বাসের উত্তাপ দুজনের মুখের ওপর আছড়ে পড়ে। অন্ধকারে দুজন মানব মানবী একে অপরকে গ্রহণ করে। তাদের উপস্থিতি স্পর্শে। লছমীর কাছে মনে হয় এ অন্য এক জগৎ। রাজবাড়ীতে তার অবস্থান আর রামাকান্তের অবস্থান যে আকাশ- পাতাল সেসব কিছুই তার মনে থাকে না। এক অদ্ভুত মাদকতা কাজ করে শরীরে, মনে।

রামাকান্ত তাকে সত্যি ভালোবাসে কি না সে জানে না। কিন্তু বিগত তিন মাসে তার সাথে যা যা হয়েছে তাতে করে সে রামাকান্তকে ভালোবেসে ফেলেছে। এটা যে অন্যায়, এটা যে পাপ সেটা খুব ভালো করে জানে লছমী। কিন্তু বাবু তাকে ডাকলে সে নিজেকে কিছুতেই সংবরণ করতে পারে না।

গত মাসে তার রজঃস্রাবের দিন চলে গেছে। এ মাসেও ৮ দিন যাচ্ছে। লছমী বাবুকে বলবে কি না ভাবছে।

– চুপ করে কী ভাবছো?

– বাবু আমার মাসিক বন্ধ।

-সেকি! কবে থেকে?

– গত মাসের পূর্ণিমার সময় হয়েছিল এখন অবধি হয়নি।

-আরে পূর্ণিমা মানে? ঠিক করে বলো!

লছমী আঙুলে হিসাব কষে বললো-আটচল্লিশ দিন হবে বাবু।

রামাকান্ত প্রচন্ড রেগে গেলেও খুব শান্তভাবে বললো

– করেছ কী তুমি? আগে বলোনি কেন? আর কাউকে জানিয়েছ?

– না

-শোন যা বলি সেটা করো। তোমার বাড়িতে কে আছেন।

– শুধু মা। বাবা ফেলে চলে গেছেন। আর ভাই মারা গেছে কলেরায়।

-আচ্ছা আচ্ছা, এত কিছু জানতে চাইনি। তুমি তোমার মায়ের কাছে চলে যাও। আমি তোমাকে খরচ যত প্রয়োজন দিয়ে দিবো। এই ঘটনা কাউকে বলো না।

কিছুদিন পরেই আমি হবো এই শোভাবাজারের একমাত্র রাজা। তখন আমি তোমাকে এখানে নিয়ে আসব। ততোদিন তুমি চুপ থাকবে।

লাছমী অঝোরে কাঁদছে।

রামাকান্ত লছমীকে বুকে জড়িয়ে, কপালে চুমু খেয়ে শান্ত করে বলে। লক্ষ্মী মেয়ে এসব যেন কেউ টের না পায়। আমার মঙ্গল হোক তা নিশ্চয়ই চাও?

কান্না জড়িত কন্ঠে শুধু বললো- হ্যাঁ চাই।

 

৪.

আজ লছমীর বিচারের দিন। রাজ দরবারের সিংহাসনে বসে আছেন নবকৃষ্ণ দেব। লছমীর অপরাধ সে ভ্রষ্টাচারী নারী এবং তার ভূমিষ্ঠ মৃত সন্তানকে লুকানোর চেষ্টা করেছে।

লছমী যখন বলে এই সন্তানের বাবা শোভাবাজারের ভাবি রাজা রামাকান্ত দেব। তখনই রাজ দরবারে গুঞ্জন শুরু হয় এবং রামাকান্তের পক্ষ হয়ে ব্রাহ্মণগণ বলেন-

” ব্রাহ্মণদের যে আইন আছে তার মধ্যে বলা আছে যে, ব্রাহ্মণ নিম্নবর্গের স্ত্রীলোকের সাথে যেকোনো ধরনের মেলামেশা করতে পারবে। এমনকি তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করলে সংসর্গ দোষ ছাড়া অন্য কোনো নৈতিক অপরাধ হবে না”।

এতে সমর্থন যুগিয়েছে সভাসদগণ। তাদের কথা আমরা কুলিন ব্রাহ্মণ। আমরা যা সিদ্ধান্ত নিবো তা সকলের মঙ্গলের জন্য।

এবং সেখানে লছমীকে সকল রূপে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।

লাছমী কিছুই বলে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দরবারের কোনায় জড়সড় হয়ে বসে থাকা রামাকান্তের দিকে। আর পুরোনো স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে থাকে। কি ভিষণ রকম ভালোই না বেসেছিল এই পাষন্ড মানুষটাকে।

পরের শনিবার ভোরে ফাঁসির সময় ধার্য করা হয়। গ্রাম থেকে মেয়ের সাথে শেষ দেখা করতে ছুটে আসেন লছমীর মা।

মেয়েকে বুকে নিয়ে তার মা বারবার বলতে থাকে এত কিছু ঘটে গেল কেন ফিরে গেলি না।

লাছমী তখন নীরব পাথর। কোনো কথা বলছে না। শুধু বললো ভালোবেসে ভুল করেছি মা।

 

৫.

সব কিছু ঠিকঠাক। ফাঁসিকাষ্ঠ তৈরি। লছমীকে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে তোলা হলো ফাঁসিকাষ্ঠে। দুজন জল্লাদের তত্তাবধানে ফাঁসির কাজ শেষ হলো। লছমীকে যখন নামানো হলো সে মৃত কি না তা পরীক্ষার জন্য তখন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। দেখা গেলো লছমীর হৃদস্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। দু-তিনজন মিলে পরীক্ষা করলো। দেখলো সত্যি সে মারা যায়নি। কিন্তু জ্ঞানও ফিরছে না। তখন এক কবিরাজ এসে তার নাকে তামাকের ধোঁয়া দিতেই নড়েচড়ে উঠল।

আর এই বিরল ঘটনা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট হয়ে পুরো শোভাবাজার ছাপিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল।

সবাই বলাবলি করতে লাগলো –

লাছমী ভগবানের চোখে নির্দোষ তাই স্বয়ং ভগবান ওকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

সূএ:ঢাকাটাইম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com