ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সংঘর্ষের রেশ এখনো কাটেনি। এখনো সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গতকাল বিকালেও সংঘর্ষে জড়ান ছাত্র-ব্যবসায়ীরা। পরে ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের অনুরোধে ছাত্ররা ক্যাম্পাসে ফিরে যান। তবে এখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটেনি। দুই পক্ষই মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এদিকে মঙ্গলবার ব্যাপক সংঘর্ষের পর গতকাল দুপুরের পর থেকে খুলতে শুরু করেছে নিউমার্কেট এলাকায় বিভিন্ন বিপণিবিতানের দোকানপাট। পরিস্থিতি শান্ত দেখে সকাল থেকে ওই এলাকায় যান চলাচল শুরুর পাশাপাশি মানুষও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছিল। কিন্তু বিকালে ঢাকা কলেজের সামনে এক ডজন হাতবোমা বিস্ফোরণের পর তা আবার বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং কুরিয়ারকর্মী হত্যার বিচারসহ তার পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবিতে বরিশালে মশাল মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। বরিশাল নগরীর বিএম কলেজ, সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, সরকারি বরিশাল কলেজ ও অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যানারে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় এই মশাল মিছিল অুনষ্ঠিত হয়।
এই বিস্ফোরণ কারা ঘটিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ১০ হাজার ব্যবসায়ীর প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি। যে কোনো সময় সংঘর্ষের আশঙ্কায় দোকান মালিক-কর্মচারী ও ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে পুলিশও। এদিকে মার্কেটে সাদা পতাকা উড়িয়ে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর আগে সোমবার রাতে দুই দোকানের কর্মচারীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে ঢাকা কলেজ ও নিউমার্কেটের দোকান মালিক-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষ গড়ায়। মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সারা দিন সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত হন, তাদের মধ্যে নাহিদ নামে একজন হাসপাতালে মারা যান। এদিকে এডিসি হারুনের প্রত্যাহার দাবি করেছেন ছাত্ররা।
সুষ্ঠু তদন্ত দাবি ব্যবসায়ীদের : গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ঘটে যাওয়া ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি চাই। অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন থেকেই আমরা দোকানপাট খুলে দিতে চাই। সংবাদ সম্মেলনের পর বেলা ৩টা থেকে গাউছিয়া, বলাকা ভবন, চাঁদনী চকের কিছু দোকান খুলতে শুরু করে। তবে নিউমার্কেটের কোনো দোকান খোলেনি। সংবাদ সম্মেলনে নিউমার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘সোমবার রাতে ঢাকা নিউমার্কেটের দুটি ফাস্টফুডের দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে কথাকাটাকাটি ঘটনার একপর্যায়ে রাতে একটি সংঘবদ্ধ দল মার্কেটের ৪ নম্বর গেটসহ অন্যান্য স্থানে ভাঙচুর শুরু করে। এমন পরিস্থিতিতে আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছাই এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য কামনা করি।’
তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। এই এলাকার সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সত্ত্বেও একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতার দিনব্যাপী ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্য দিয়ে বেসরকারি খাতে কর্মরত একজন কর্মী নিহত হন। এ ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাংবাদিক ও সংবাদ কর্মীরা। এ জন্য গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।’ এ ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রত্যাশা করে শাহিন বলেন, ‘কয়েক দিনের মধ্যে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং অত্র এলাকার ব্যবসায়ীদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি কোর কমিটি গঠনের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করব, যাতে যে কোনো ঘটনা আলোচনার ভিত্তিতে সুষ্ঠু সমাধান করতে পারি। এ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এর নিরপেক্ষ তদন্তের ভিত্তিতে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’ ঢাকা কলেজকে একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দেশের মেধাবী ছাত্ররাই এখানে লেখাপড়া করেন। আমরা লক্ষ্য করছি যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। আপনারা জানেন করোনাকালে বিগত দুই বছরে ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। ছাত্রদের নিয়ে কোনো ধরনের উসকানিমূলক কথা না বলার জন্য নিউমার্কেট এলাকার দোকান মালিক ও কর্মচারীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে শাহিন বলেন, ‘পাশাপাশি ছাত্র-শিক্ষক ভাইদেরও সহনশীল আচরণ করার অনুরোধ করছি।’ ঘটনায় নিহত ও আহতদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী নেতা শাহিন বলেন, ‘সামাজিকভাবে যতটুকু দায়িত্ব নেওয়ার ততটুকু নেব।’
মঙ্গলবার যারা মারামারি করেছেন তারা ব্যবসায়ী নন দাবি করে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি নিশ্চিত এখানে তৃতীয়পক্ষ কাজ করেছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত শেষে বের হয়ে আসবে এরা কারা।’ ক্যাপিটাল হোস্টেল ও ওয়েলকাম দোকানের দুই কর্মচারীর ঝগড়া থেকে এ ঘটনার সূত্রপাত বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
সুরাহা না করে মার্কেট খুললে ফের বিক্ষোভের হুমকি ছাত্রদের : দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা সমাধান করার আগে নিউমার্কেটের দোকান খোলা হলে আবারও বিক্ষোভে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ছাত্ররা। তাদের দাবি, ছাত্রদের ওপর হামলা, কলেজের প্রশাসনিক ভবনে গুলি, কাঁদানে গ্যাস ছোড়াসহ গত দুই দিনের পরিস্থিতির জন্য দায়ীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত নিউমার্কেট খোলা যাবে না।
ছাত্রদের শান্ত রাখতে শিক্ষকদের বৈঠক : গতকাল সকাল থেকে ঢাকা কলেজের শিক্ষকরা বৈঠক করলেও সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা সেখান থেকে আসেনি। দুপুরে বৈঠক শেষে ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এ টি এম মইনুল হোসেন বলেন, ‘বৈঠক একেবারেই আমাদের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ছিল। এখানে ছাত্রদের বিষয়টিও উঠেছে। আমরা পরিকল্পনা করছি কীভাবে ছাত্রদের শান্ত রাখা যায়। ছাত্ররা যাতে আর কোনো ঝামেলায় না জড়ায় সে বিষয়টি নিজ নিজ অবস্থান থেকে শিক্ষকরা নজরে রাখবেন। তা ছাড়া ছাত্রদের সঙ্গেও আমরা কথা বলব।’
সাদা পতাকা তুললেন ব্যবসায়ীরা : শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকানকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষের পর ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার বিপণিবিতানগুলোর ছাদে এখন উড়ছে সাদা পতাকা। এর মাধ্যমে ‘আর সংঘর্ষ নয়, শান্তি চাই’- এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন দোকানিরা। সংঘর্ষের কারণে মঙ্গলবার সারা দিনে ওই এলাকার কোনো দোকান খোলেনি। গতকাল সকালে পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ওই এলাকার বিভিন্ন বিপণিবিতানের ছাদে সাদা পতাকা উড়তে দেখা যায়। ঢাকা কলেজের বিপরীতে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের ওপর তিনটি সাদা পতাকা, নূর ম্যানশনের ছাদে দুটি, নিউমার্কেটের বিপরীতে গাউছিয়া মার্কেটের ছাদে একটি ও ইসমাইল ম?্যানশনের ছাদে দুটি পতাকা উড়তে দেখা গেছে।
তৃতীয়পক্ষ অনুপ্রবেশ করেছে : বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘নিউমার্কেটের মালিক, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা সম্মানজনক অবস্থানে থাকেন। অ্যাম্বুলেন্সে যারা আক্রমণ করেছে আমি মনে করি তাদের কোনো বোধশক্তি নেই। তারা ব্যবসায়ী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এরা একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আমি নিশ্চিত করেই বলছি, এখানে তৃতীয় পক্ষ ছিল। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আছে। পুলিশ এক পক্ষকে সরিয়ে দিলে আরেক পক্ষ বেরিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে, এখানে তৃতীয় পক্ষ কাজ করেছে। এখানে ব্যবসায়ী ছিল না। আমরা মনে করি ছাত্ররাও ছিল না। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এত বড় ঘটনা ঘটবে তা আমাদের কারোরই মাথায় আসেনি। যদি দেখি কোনো ব্যবসায়ী সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’ পুলিশের নিউমার্কেট জোনের এডিসি শাহেন শাহ বলেন, ‘বর্তমানে এ এলাকার পরিস্থিতি শান্ত-স্বাভাবিক রয়েছে। ছাত্ররা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছে, পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও শান্ত থাকতে বলেছি। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে যা যা করণীয় পুলিশ সব করেছে। এতে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সবাই আমাদের সহযোগিতা করেছেন।’ গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘যে কোনো পরিস্থিতিতে পুলিশ প্রথমত সংঘর্ষে জড়ানো পক্ষগুলোকে নিবৃত করার চেষ্টা করে। এ জন্য নেগোসিয়েশন করার চেষ্টা করা হয়। দুই পক্ষকে নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করা হয়। একটি মানুষ নিহত তো দূরে থাক, কেউ যেন আহতও না হয় সে চেষ্টাই করে পুলিশ। কিন্তু এ ঘটনায় অনাকাক্সিক্ষতভাবে একজন নিহত হয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। পুলিশ কিন্তু শুরু থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করেছে।’ সংঘর্ষ চলাকালে রমনার এডিসি হারুনের ভূমিকা, গোলাবারুদ শেষ হওয়ায় অন্য পুলিশ সদস্যকে থাপ্পড় মারাসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ বলেন, ‘কোন পরিস্থিতিতে এডিসির থাপ্পড় মারা ও গুলি শেষ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। আপাতত পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাতেই মনোযোগী।’ এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ঢাকা কলেজ ঐতিহ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান থেকে যারা বের হয়েছেন তাদের অনেকে ভালো অবস্থানে আছেন। করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সামনে ঈদ। ব্যবসায়ীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময় এটি। এর মধ্যে নিউমার্কেটের শ্রমিক-ব্যবসায়ী ও ছাত্রদের মধ্যে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জেরে সংঘাত হয়, মারামারি হয়। তিনি বলেন, ‘উভয় পক্ষকে নিয়ে পুলিশ শুরু থেকেই সমঝোতার চেষ্টা চালিয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশের সমঝোতা ছাড়া উপায়ও থাকে না। দ্বিতীয়ত, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে উভয় পক্ষকে সরে যেতে বলেছি। তৃতীয়ত, নন লেথাল উইপন (অস্ত্র) ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। সামনে ঈদ। কালকের পর থেকে কলেজগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ছাত্র-ব্যবসায়ীদের মধ্যকার তুচ্ছ ঘটনা থেকে সূত্রপাত হওয়া এ সংঘাতের সমাপ্তি জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সন্তানরাও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন। ঈদকে কেন্দ্র করেই তাদের ব্যবসা। সারা বছর তারা বসে থাকেন। তাদেরও পরিবার আছে। তবে তাদেরও উচিত জনগণের সঙ্গে খারাপ আচরণ না করা। আমি ছাত্রদের আহ্বান করব, সংঘাতে না যাই, ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় কোনো বাধা সৃষ্টি করি। সবাই সবার মতো নিজের কাজ করি। সংঘাতে না জড়াই, সংযম রক্ষা করি।’ সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন