টিপু হত্যার নীল নকশা

মতিঝিল আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুর রহমান টিপু ও কলেজ শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যার শুটার মাসুম মো. ওরফে আকাশকে গ্রেপ্তার করার পরও এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ, নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও কিলারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ডিবি নিশ্চিত হয় মাসুমই সেই কিলার। গতকাল বগুড়া জেলা থেকে গ্রেপ্তারের পর ডিবি কর্মকর্তা দফায় দফায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু পেশাদার এই খুনি অগোছালো সব তথ্য দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদে কেন এই হত্যাকাণ্ড, কার কাছ থেকে কিলিং কন্ট্রাক্ট পেয়েছে, এর পেছনে কারা কারা জড়িত ঠিকঠাক কোনো তথ্য দেয়নি মাসুম। তবে তার কাছ থেকে পাওয়া কিছু নামের ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে ডিবি। তার সঙ্গে ওই ব্যক্তিদের মুখোমুখি করালে অনেক সত্য বের হয়ে আসবে বলে ধারণা করছে ডিবি। তদন্তে পাওয়া আরও কিছু তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

এই শুটারকে রিমান্ডে এনে আরও বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে আশা করছে ডিবি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
কিলার মাসুম মোহাম্মদপুর এলাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর পড়াশোনা করেছে। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবের কাইশকানি। ঢাকার পশ্চিম মাদারটেক এলাকায় থাকতো। তার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। তার স্ত্রী ও এক সন্তান আছে। নেশার জগতে যুক্ত না থাকলেও অপরাধ জগতে মাসুম বেশ পাকাপোক্ত। বিভিন্ন অপরাধে অনেক মামলা তার মাথার উপরে। অপরাধজগতে জড়িয়ে একটি হত্যা মামলাসহ চার-পাঁচটি মামলার ফেরারি আসামি। ডিবি পুলিশকে মাসুম জানিয়েছে, মূলত বিভিন্ন মামলার জন্য সে শান্তিতে বাস করতে পারছিল না। সবসময় মানসিক একটা অশান্তির মধ্যে থাকতে হতো। তাই যেকোনোভাবে মাসুম চাইছিল এসব মামলা থেকে মুক্তি। তাই মামলা থেকে মুক্তি ও আরও কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্য টিপুকে হত্যা করতে রাজি হয়। প্রাথমিকভাবে দু’জন ব্যক্তির কথা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে জানিয়েছে মাসুম। তারা হলেন- মুসা ও শামীম। মুসা হচ্ছেন যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের আসামি। আর শামীমের পরিচয় জানা যায়নি।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, হত্যার পাঁচদিন আগে ২০শে মার্চ মাসুম জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার কন্ট্রাক্ট পায়। আর তিনদিন আগে যাকে হত্যা করতে হবে তার নাম পরিচয় ও ছবি পায়। পরে কাট আউট সিস্টেমে কমলাপুরের ইনল্যান্ড ডিপো এলাকা থেকে মাসুম একটি মোটরসাইকেল ও হত্যার কাজে ব্যবহৃত পিস্তল সংগ্রহ করেছে। ঘটনার আগের দিন ২৩শে মার্চ জাহিদুল ইসলাম টিপুকে তার এজিবি কলোনির রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় যাওয়ার রাস্তায় অনুসরণ করে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু বেশি লোকজন থাকায় সে ব্যর্থ হয়। ঘটনার দিন ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একজন ফোন করে মাসুমকে জানায়, টিপু তার রেস্টুরেন্টে অবস্থান করছে। এ সংবাদ পেয়ে মাসুম রেস্টুরেন্টের কাছ থেকে টিপুকে অনুসরণ করা শুরু করে এবং গুলি করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু টিপু অনেক লোকজনের মধ্যে থাকায় গুলি করতে না পেরে টিপুর গাড়ি অনুসরণ করে। গাড়িটি শাহজাহানপুর রেল লাইনের আগে আমতলা সংলগ্ন রাস্তায় যানজটে আটকা পড়লে মাসুম গাড়ির চালকের পাশের আসনে বসা টিপুকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি করে পালিয়ে যায়।

ডিবি প্রধান বলেন, ঘটনার পর দুই বন্ধুর সহযোগিতায় নিরাপদ স্থানে আত্মগোপনে যায় শুটার মাসুম। পরে ফেসবুকের মাধ্যমে নিরপরাধ রিকশা আরোহী প্রীতি এবং টিপুর মৃত্যুর সংবাদ দেখতে পায়। এরপর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে জয়পুরহাট চলে যায়। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পার হতে না পেরে বগুড়ায় চলে আসে। যে গাড়িতে তিনি যাদেরকে নিয়ে জয়পুরহাটে গিয়েছিল, সেই গাড়ির লোকজন ঢাকায় আসার পর তাদের নিয়ে বগুড়ায় যায় পুলিশ। পরে বগুড়া জেলা পুলিশের সহায়তায় মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রীতি হত্যা নিয়ে মাসুম ডিবিকে জানিয়েছে, তার টার্গেট ছিল টিপুকে হত্যা করা। তাই সে অস্ত্রের ট্রিগার চেপে ধরেছিল। একাধারে গুলি বের হচ্ছিল। প্রীতিকে টার্গেট করে গুলি করেনি। প্রীতির শরীরে যে গুলি লেগেছে সেটা জানতো না। হত্যার পরের দিন টিভি দেখে জেনেছে।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুরো কিলিং মিশনটি কাট আউট পদ্ধতিতে হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশন রয়েছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জড়িত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাসুম জানিয়েছে, মুসা ও শামীম ছাড়া আর কাউকে সে চিনে না। কাট আউট পদ্ধতিতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সংগ্রহ করেছে। আবার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কেউ কারও নাম জানে না। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে অটোমেটেড পিস্তল। তাই মাত্র ২০ সেকেন্ডে এক চাপেই ১২ রাউন্ড গুলি বের হয়েছে। আগে থেকে পিস্তল চালানোয় পারদর্শী ছিল মাসুম।

ডিবি জানায়, মাসুমের দেয়া বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে আসলে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত। কে তাকে এই কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। কিসের বিনিময়ে কন্ট্রাক্টে রাজি হয়েছে। যদিও প্রাথমিকভাবে সে মুসা ও শামীমের নাম বলছে। অথচ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে মুসার সঙ্গে তার মাত্র দুবার দেখা হয়েছে। এ ছাড়া মুসা নিজেও হত্যা মামলার আসামি। তার মামলার সুরাহা করতে পারছে না। কিন্তু মাসুম বলেছে, মুসা তাকে সমস্ত মামলা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবে এই কন্ট্রাক্টে কাজ করেছেন। ডিবির মতে, যেখানে মুসা নিজেই তার মামলা নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করছে সেখানে মাসুমকে কীভাবে সহযোগিতা করবে। তাই এসব তথ্যর কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি মুসাকে গ্রেপ্তার করা যায় তবে এসব তথ্যর সত্যতা মিলবে।

ডিবি বলছে, টিপু হত্যাকাণ্ডের চুক্তিতে টাকার লেনদেন হয়েছিল কিনা সেটি যাচাই করার জন্য মাসুম, তার স্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাচাই করা হবে। লেনদেন হলে সেটি ঘটনার আগে পরে যেকোনো সময় হতে পারে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ঘটনার পর থেকে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সেটি বের করার জন্য মতিঝিল এলাকার একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও কয়েকজন কাউন্সিলরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। টেন্ডারবাজি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব আছে কিনা সেজন্য এ ছাড়া ক্রীড়া ভবনের ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার সোহেলসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পাশাপাশি ডিশ ব্যবসা নিয়ে কোনো ঝামেলা আছে কিনা সেজন্য ওই এলাকার ডিশ ব্যবসা যারা নিয়ন্ত্রণ করেন জাহাঙ্গীর, ফারুক ও হাসানকে জেরা করা হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে ২০১৬ সালে যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবুকে হত্যা করা হয়। এই মামলার আসামি ছিলেন মুসা। বোচা বাবুর বাবা আবুল কালাম আজাদ নিহত টিপুর ঘনিষ্ঠজন। তারা একসঙ্গেই থাকতেন। বোচা বাবু হত্যা মামলার সব খরচ বহন করতেন টিপুই। ঘটনার সময় গাড়ির পেছনে যে দু’জন বসা ছিলেন, তাদের একজন এই আবুল কালাম। বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের পর বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে আসেন। আসামি সাগরের সঙ্গে আবুল কালামের মীমাংসা হয় টিপুর মধ্যস্থতায়। অন্য আসামি শুটার নেসার, মতিঝিল এলাকার সবচেয়ে দক্ষ শুটার হিসেবে পরিচিত সাব শুটার মুসা ও তার ভাই সালেহ মীমাংসার জন্য টিপুর দারস্থ হন। কিন্তু টিপু তাদের আবদার না শোনায় তারা সবাই মনঃক্ষুণ্ন হন। নেসার, মুসা ও তার ভাই সালেহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের জিসান এবং বিকাশ ও তার ভাই প্রকাশের অনুসারী। বাবু হত্যা মামলার মীমাংসা না পেয়ে এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন ওই শুটারদের কেউ।

২০১৩ সালের ২৯শে জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তৎকালীন দক্ষিণ যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যার এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন টিপু। মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও মিল্কির শুভাকাঙ্ক্ষীরা ওই হত্যার প্রতিশোধ নিতে অথবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডের ওই তিন গডফাদারের মাধ্যমে টিপুকে হত্যা করাতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন টিপু। ক্যাসিনোকাণ্ডে ওই দুই নেতা জেলহাজতে গেলে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে আসে টিপুর কাছে। বেশ কয়েক বছর ধরে টিপু এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন। এসব থেকে তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন সুবিধা প্রত্যাশী অন্যরা। মতিঝিল এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারও ক্ষোভের বলি হতে পারেন টিপু।  সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» তারুণ্য সমৃদ্ধ দেশ গড়ার অঙ্গিকার জামায়াত আমিরের

» ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জামায়াতের অভিনন্দন

» সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে প্রেস সেক্রেটারি মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত মামলা বাতিল হবে

» উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলে নীতিগত সিদ্ধান্ত

» ইউটিলিটি বিল কালেকশন সহজ করতে তিতাস গ্যাসের সাথে ব্র্যাক ব্যাংকের চুক্তি

» ইসলামপুরে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালিত

» ময়নামতি ও বসুরহাটে ইউসিবির দুই নতুন শাখা উদ্বোধন

» প্রাইম ব্যাংক’র সাথে পেরোল চুক্তি করলো বিএস গ্রুপ

» বিমক্স ২০২৪ -এ অংশ নিয়ে অত্যাধুনিক সব পণ্য প্রদর্শন করছে এনার্জিপ্যাক

» চালককে হত্যার পর অটোরিকশা ছিনতাই যাদের নেশা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

টিপু হত্যার নীল নকশা

মতিঝিল আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুর রহমান টিপু ও কলেজ শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যার শুটার মাসুম মো. ওরফে আকাশকে গ্রেপ্তার করার পরও এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ, নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও কিলারের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ডিবি নিশ্চিত হয় মাসুমই সেই কিলার। গতকাল বগুড়া জেলা থেকে গ্রেপ্তারের পর ডিবি কর্মকর্তা দফায় দফায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু পেশাদার এই খুনি অগোছালো সব তথ্য দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদে কেন এই হত্যাকাণ্ড, কার কাছ থেকে কিলিং কন্ট্রাক্ট পেয়েছে, এর পেছনে কারা কারা জড়িত ঠিকঠাক কোনো তথ্য দেয়নি মাসুম। তবে তার কাছ থেকে পাওয়া কিছু নামের ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে ডিবি। তার সঙ্গে ওই ব্যক্তিদের মুখোমুখি করালে অনেক সত্য বের হয়ে আসবে বলে ধারণা করছে ডিবি। তদন্তে পাওয়া আরও কিছু তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

এই শুটারকে রিমান্ডে এনে আরও বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ করলে বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে আশা করছে ডিবি কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে এমন বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
কিলার মাসুম মোহাম্মদপুর এলাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাফিক্স ডিজাইনের ওপর পড়াশোনা করেছে। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের মতলবের কাইশকানি। ঢাকার পশ্চিম মাদারটেক এলাকায় থাকতো। তার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক। তার স্ত্রী ও এক সন্তান আছে। নেশার জগতে যুক্ত না থাকলেও অপরাধ জগতে মাসুম বেশ পাকাপোক্ত। বিভিন্ন অপরাধে অনেক মামলা তার মাথার উপরে। অপরাধজগতে জড়িয়ে একটি হত্যা মামলাসহ চার-পাঁচটি মামলার ফেরারি আসামি। ডিবি পুলিশকে মাসুম জানিয়েছে, মূলত বিভিন্ন মামলার জন্য সে শান্তিতে বাস করতে পারছিল না। সবসময় মানসিক একটা অশান্তির মধ্যে থাকতে হতো। তাই যেকোনোভাবে মাসুম চাইছিল এসব মামলা থেকে মুক্তি। তাই মামলা থেকে মুক্তি ও আরও কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্য টিপুকে হত্যা করতে রাজি হয়। প্রাথমিকভাবে দু’জন ব্যক্তির কথা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে জানিয়েছে মাসুম। তারা হলেন- মুসা ও শামীম। মুসা হচ্ছেন যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের আসামি। আর শামীমের পরিচয় জানা যায়নি।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, হত্যার পাঁচদিন আগে ২০শে মার্চ মাসুম জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার কন্ট্রাক্ট পায়। আর তিনদিন আগে যাকে হত্যা করতে হবে তার নাম পরিচয় ও ছবি পায়। পরে কাট আউট সিস্টেমে কমলাপুরের ইনল্যান্ড ডিপো এলাকা থেকে মাসুম একটি মোটরসাইকেল ও হত্যার কাজে ব্যবহৃত পিস্তল সংগ্রহ করেছে। ঘটনার আগের দিন ২৩শে মার্চ জাহিদুল ইসলাম টিপুকে তার এজিবি কলোনির রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় যাওয়ার রাস্তায় অনুসরণ করে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু বেশি লোকজন থাকায় সে ব্যর্থ হয়। ঘটনার দিন ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একজন ফোন করে মাসুমকে জানায়, টিপু তার রেস্টুরেন্টে অবস্থান করছে। এ সংবাদ পেয়ে মাসুম রেস্টুরেন্টের কাছ থেকে টিপুকে অনুসরণ করা শুরু করে এবং গুলি করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু টিপু অনেক লোকজনের মধ্যে থাকায় গুলি করতে না পেরে টিপুর গাড়ি অনুসরণ করে। গাড়িটি শাহজাহানপুর রেল লাইনের আগে আমতলা সংলগ্ন রাস্তায় যানজটে আটকা পড়লে মাসুম গাড়ির চালকের পাশের আসনে বসা টিপুকে লক্ষ্য করে উপর্যুপরি গুলি করে পালিয়ে যায়।

ডিবি প্রধান বলেন, ঘটনার পর দুই বন্ধুর সহযোগিতায় নিরাপদ স্থানে আত্মগোপনে যায় শুটার মাসুম। পরে ফেসবুকের মাধ্যমে নিরপরাধ রিকশা আরোহী প্রীতি এবং টিপুর মৃত্যুর সংবাদ দেখতে পায়। এরপর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে জয়পুরহাট চলে যায়। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পার হতে না পেরে বগুড়ায় চলে আসে। যে গাড়িতে তিনি যাদেরকে নিয়ে জয়পুরহাটে গিয়েছিল, সেই গাড়ির লোকজন ঢাকায় আসার পর তাদের নিয়ে বগুড়ায় যায় পুলিশ। পরে বগুড়া জেলা পুলিশের সহায়তায় মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রীতি হত্যা নিয়ে মাসুম ডিবিকে জানিয়েছে, তার টার্গেট ছিল টিপুকে হত্যা করা। তাই সে অস্ত্রের ট্রিগার চেপে ধরেছিল। একাধারে গুলি বের হচ্ছিল। প্রীতিকে টার্গেট করে গুলি করেনি। প্রীতির শরীরে যে গুলি লেগেছে সেটা জানতো না। হত্যার পরের দিন টিভি দেখে জেনেছে।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুরো কিলিং মিশনটি কাট আউট পদ্ধতিতে হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কানেকশন রয়েছে। বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জড়িত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাসুম জানিয়েছে, মুসা ও শামীম ছাড়া আর কাউকে সে চিনে না। কাট আউট পদ্ধতিতে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সংগ্রহ করেছে। আবার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিয়েছে। কেউ কারও নাম জানে না। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে অটোমেটেড পিস্তল। তাই মাত্র ২০ সেকেন্ডে এক চাপেই ১২ রাউন্ড গুলি বের হয়েছে। আগে থেকে পিস্তল চালানোয় পারদর্শী ছিল মাসুম।

ডিবি জানায়, মাসুমের দেয়া বিভ্রান্তিকর তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে আসলে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত। কে তাকে এই কন্ট্রাক্ট দিয়েছে। কিসের বিনিময়ে কন্ট্রাক্টে রাজি হয়েছে। যদিও প্রাথমিকভাবে সে মুসা ও শামীমের নাম বলছে। অথচ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে মুসার সঙ্গে তার মাত্র দুবার দেখা হয়েছে। এ ছাড়া মুসা নিজেও হত্যা মামলার আসামি। তার মামলার সুরাহা করতে পারছে না। কিন্তু মাসুম বলেছে, মুসা তাকে সমস্ত মামলা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দিবে এই কন্ট্রাক্টে কাজ করেছেন। ডিবির মতে, যেখানে মুসা নিজেই তার মামলা নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করছে সেখানে মাসুমকে কীভাবে সহযোগিতা করবে। তাই এসব তথ্যর কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি মুসাকে গ্রেপ্তার করা যায় তবে এসব তথ্যর সত্যতা মিলবে।

ডিবি বলছে, টিপু হত্যাকাণ্ডের চুক্তিতে টাকার লেনদেন হয়েছিল কিনা সেটি যাচাই করার জন্য মাসুম, তার স্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাচাই করা হবে। লেনদেন হলে সেটি ঘটনার আগে পরে যেকোনো সময় হতে পারে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ঘটনার পর থেকে এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা সেটি বের করার জন্য মতিঝিল এলাকার একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও কয়েকজন কাউন্সিলরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। টেন্ডারবাজি নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব আছে কিনা সেজন্য এ ছাড়া ক্রীড়া ভবনের ঠিকাদারির সঙ্গে জড়িত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার সোহেলসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পাশাপাশি ডিশ ব্যবসা নিয়ে কোনো ঝামেলা আছে কিনা সেজন্য ওই এলাকার ডিশ ব্যবসা যারা নিয়ন্ত্রণ করেন জাহাঙ্গীর, ফারুক ও হাসানকে জেরা করা হয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে ২০১৬ সালে যুবলীগ নেতা রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবুকে হত্যা করা হয়। এই মামলার আসামি ছিলেন মুসা। বোচা বাবুর বাবা আবুল কালাম আজাদ নিহত টিপুর ঘনিষ্ঠজন। তারা একসঙ্গেই থাকতেন। বোচা বাবু হত্যা মামলার সব খরচ বহন করতেন টিপুই। ঘটনার সময় গাড়ির পেছনে যে দু’জন বসা ছিলেন, তাদের একজন এই আবুল কালাম। বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের পর বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে আসেন। আসামি সাগরের সঙ্গে আবুল কালামের মীমাংসা হয় টিপুর মধ্যস্থতায়। অন্য আসামি শুটার নেসার, মতিঝিল এলাকার সবচেয়ে দক্ষ শুটার হিসেবে পরিচিত সাব শুটার মুসা ও তার ভাই সালেহ মীমাংসার জন্য টিপুর দারস্থ হন। কিন্তু টিপু তাদের আবদার না শোনায় তারা সবাই মনঃক্ষুণ্ন হন। নেসার, মুসা ও তার ভাই সালেহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের জিসান এবং বিকাশ ও তার ভাই প্রকাশের অনুসারী। বাবু হত্যা মামলার মীমাংসা না পেয়ে এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন ওই শুটারদের কেউ।

২০১৩ সালের ২৯শে জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তৎকালীন দক্ষিণ যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যার এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন টিপু। মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেও মিল্কির শুভাকাঙ্ক্ষীরা ওই হত্যার প্রতিশোধ নিতে অথবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডের ওই তিন গডফাদারের মাধ্যমে টিপুকে হত্যা করাতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়ার ঘনিষ্ঠ ছিলেন টিপু। ক্যাসিনোকাণ্ডে ওই দুই নেতা জেলহাজতে গেলে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে আসে টিপুর কাছে। বেশ কয়েক বছর ধরে টিপু এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন। এসব থেকে তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন সুবিধা প্রত্যাশী অন্যরা। মতিঝিল এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কারও ক্ষোভের বলি হতে পারেন টিপু।  সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com