ছবি সংগৃহীত
বিশ্বের অন্যতম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে দেশের তালিকায় শুরুতেই আছে জাপান। জাপানে গেলে দেখবেন পাড়া বা মহল্লার মধ্যে কিংবা কোনো রাস্তায় ডাস্টবিন নেই। যারা প্রথমবার জাপানে গেছেন তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন এই ব্যাপারে।
জাপানের কোথাও কোনো ডাস্টবিন নেই। কিংবা বাড়ির ময়লাও কেউ রাস্তার পাশে জমা করে রাখতে পারেন না। রাস্তায় হাঁটতে যদি আপনি কিছু খান তাহলে সেই ময়লা আপনাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। যদিও জাপানের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খাবার খান না।
জাপানিরা পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে এতটাই সচেতন যে, যত ক্ষণ না সঠিক ভাবে ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করা সম্ভব, তত ক্ষণ তাঁরা সেই ময়লা আবর্জনা নিয়ে রাস্তায় বেরোন না। জাপানের অধিবাসীরা যখন-তখন বাড়ির ডাস্টবিনে রাখা আবর্জনা নিয়ে বাইরে বেরোতে পারেন না। যখন-তখন রাস্তার ধারে আবর্জনা ভর্তি ব্যাগ রেখে দেওয়া জাপানে সম্ভব হয় না।
সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে এলাকায় আবর্জনা পরিষ্কার করতে আসেন পুরকর্মীরা। তখনই সকলকে আবর্জনা নিয়ে বেরোনোর নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। সে কারণে রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে কোথাও ময়লা ফেলার ডাস্টবিন চোখে পড়ে না বললেই চলে।
কিন্তু জাপানের রাস্তা এমন পরিষ্কার এবং ডাস্টবিন না রাখার কারণ জানেন কি? শুধুই কি দেশটিকে পরিষ্কার রাখার জন্যই এমন ব্যবস্থা নাকি এর পেছনে আছে অন্য কোনো গল্প। চলুন আজ আপনাদের জানাবো জাপানের এই পরিকল্পনার পেছনের করুণ এক কাহিনি।
কারণ ময়লা নিয়ে যত্রতত্র চলাফেরা করা জাপানের সংস্কৃতি বিরোধী। জাপানিদের একটি নিজস্ব ধর্ম আছে, তা হলো ‘শিনতো’। এর মূল মর্মবাণীই হলো পরিচ্ছন্নতা। এই সাংস্কৃতিক নিয়মটি জাপানি সমাজে গভীর ভাবে গেঁথে আছে।
জাপানে আবর্জনা পাত্র দেখতে না পাওয়ার আর একটি কারণ হল নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ। দু’দশক আগে ১৯৯৬ সালে টোকিওর সাবওয়েতে হয়েছিল এক রাসায়নিক হামলা। এই অন্তর্ঘাতের সঙ্গে জড়িত ছিল জাপানের এক গুপ্ত সংঘ, নাম তার অম শিনরিকো।
সারিন গ্যাসের হামলায় ১৩ জন যাত্রীর মৃত্যু হয়। ৫৪ জন গুরুতর আহত হয়েছিলেন এবং আরও ৯৮০ জন এই গ্যাসের প্রভাবে পরবর্তী সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। সারিন এক ধরনের রাসায়নিক মরণ গ্যাস। বর্ণ, গন্ধ বা স্বাদহীন এই তরল রাসায়নিক বাতাসের সংস্পর্শে এলে মুহূর্তে বাষ্পের মতো মিশে যায়। আর সেই বিষাক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিলেই আক্রান্ত হয় মানুষ।
সেই হামলার পর থেকেই ‘পাবলিক ট্র্যাশ ক্যান’কে জাপানের প্রকাশ্য স্থান থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। বিস্ফোরক বা অন্যান্য বিপজ্জনক জিনিসগুলো লুকিয়ে রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এই আশঙ্কায় আবর্জনা পাত্রগুলো জাপানের রাস্তাঘাট বা জনবহুল স্থান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
জাপানিরা যে কোনো পুরোনো জিনিসকেই পুনর্ব্যবহারযোগ্য করায় বিশ্বাসী। প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা সংস্থা তথ্য অনুসারে, জাপানে ৭৭ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারযোগ্য করা হয়।
জাপানে ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্তরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি একটি দৃঢ় দায়বদ্ধতা লক্ষ করা যায়। এর মানে হল যে জাপানিরা নিজেরাই আবর্জনা বাছাই করে, যতটা সম্ভব পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে বিপজ্জনক উপকরণগুলি সঠিক জায়গায় ফেরত পাঠান।অনেক ক্ষেত্রে, বর্জ্য সংগ্রহকে সরকারি দায়িত্ব বলে এড়িয়ে না গিয়ে ব্যক্তি বা সামাজিক গোষ্ঠী নিজেরাই ব্যবস্থা করেন। জাপানের বর্জ্য হ্রাস এবং ব্যবস্থাপনায় সাফল্যের চাবিকাঠি এটাই।
তবে কোভিডের বিধিনিষেধ হ্রাস পাওয়ার পরে জাপানে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আনাগোনা ক্রমশই বাড়ছে। জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের বয়ে আনা আবর্জনায় রাস্তাঘাট ভরে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে ট্র্যাশ ক্যানগুলো পুনরায় ফিরিয়ে আনা হচ্ছে জাপানে। সূত্র: ব্লমবার্গ