এ বছরও কোরবানির পশুর চামড়ার প্রত্যাশিত দাম পেল না কেউ। যদিও সরকার চামড়ার দাম বাড়িয়েছে। রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে- ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম একদমই নেই। প্রত্যাশা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া পাননি রাজধানীর বড় আড়তদাররা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে যারা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেন, তারাও পোস্তার পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দাম পাননি সে রকম। ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে নেওয়ার পর থেকেই চামড়ার দর পতন হতে শুরু করে। গেল দুই বছর অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী লোকসান গুনে এবার তারা আগের মতো চামড়া সংগ্রহে নামেননি। এর প্রভাব পড়েছে পোস্তার আড়তে। সরকারি তথ্য বলছে, গতবারের চেয়ে এবার সাড়ে ৮ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। গত বছর সারা দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল। এ বছর সারা দেশে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সাধারণ সম্পাদক মো. টিপু সুলতান বলেন, সব কাঁচা চামড়া পোস্তায় না এনে নিজ নিজ এলাকায় লবণ দিয়ে রাখতে আমরা সবাইকে অনুরোধ করেছিলাম। এ কারণে পোস্তায় চামড়া কম এসেছে। আবার ১০০টি চামড়ার মধ্যে ১০টি নষ্ট হয়। সেই লোকসান হিসাব করেই ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনছেন। ফলে এটিকে কম দাম বলা যাবে না। সংরক্ষণের জন্য চামড়া প্রতি ৫-৬ কেজি লবণ প্রয়োজন হয়, তবে ঈদে অপেশাদার শ্রমিক কাজ করায় লবণের পরিমাণ বেশি লাগে। এসব মিলিয়ে চামড়া প্রতি ৩০০ টাকার মতো খরচ হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন- ঈদের দিনই ট্যানারির মালিকেরা প্রায় সাড়ে তিন লাখ কাঁচা চামড়া কিনেছেন। গত বছরের তুলনায় এবার ঈদের দিন ৫০ হাজার বেশি কাঁচা চামড়া কিনেছেন ট্যানারির মালিকেরা।
রাজধানীতে চামড়া কেনার কেউ নেই : টানা কয়েক বছর বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ায় এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাননি। করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাও এর আরেকটি কারণ। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় ঈদুল আজহার প্রথম দিন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের দেখা মেলেনি। পাশাপাশি চামড়ার দাম না থাকায় বিক্রির ব্যাপারেও কারও আগ্রহ দেখা যায়নি। ক্রেতা না থাকায় অধিকাংশ লোকজন নিকটস্থ মাদরাসা ও এতিমখানায় কোরবানির পশুর চামড়া দান করেছেন। মাদরাসার ছাত্ররা ভ্যানে করে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে রাস্তার মোড়ে এনে বিক্রি করার জন্য জমা করেন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। মোড়ে মোড়ে কাঁচা চামড়া তাদের নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। কিছু কিছু মাদরাসায় কাঁচা চামড়ায় লবণ লাগিয়ে সংরক্ষণ হচ্ছে। পরে সেখান থেকে নিয়ে বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করা হবে। মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রতি বছর চামড়াজাতীয় পণ্যের দাম বাড়লেও কমছে চামড়ার দাম। বিষয়টি খুবই রহস্যজনক। সরকারও সব সময় ব্যবসায়ীদের কথা শুনেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করছে যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
রাজধানীতে ছোট গরুর চামড়ার দাম নেই : কোরবানির চামড়া ক্রয়-বিক্রয়ের সবচেয়ে বড় জায়গা রাজধানীর পুরান ঢাকার পোস্তা। গত রবিবার দুপুরের পর বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া আসতে থাকে পোস্তায়। সময় যত গড়ায় তত বেচাবিক্রি জমে ওঠে। শুরুতে ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম কিছুটা মিললেও বিকাল যত গড়ায় দাম তত পড়তে থাকে। এখানে দুপুরের পর ছোট আকারের গরুর চামড়া ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে অধিকাংশ আড়তদার ছোট আকারের গরুর চামড়া এবং খাসির চামড়া কিনতে অনীহা দেখান। বিকালে দেখা যায়, ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম ১০০ টাকা বলছেন আড়তদাররা। আর খাসির চামড়া ১০ টাকার বেশি বিক্রি হয়নি পোস্তায়। এ প্রসঙ্গে পোস্তার আড়তদার মো. দীপু গণমাধ্যমকে বলেন- একটি চামড়া ৬০০ টাকায় কেনার পর লবণ ও শ্রমিকের পেছনে ৩০০ টাকা খরচ পড়ছে। ট্যানারির মালিকেরা যখন চামড়া কিনতে আসবেন, তখন তাঁরা নানা অজুহাতে দাম কমাবেন। আমরা তাঁদের কাছে জিম্মি।
পোস্তায় চামড়া এসেছে কম : চামড়া ব্যবসা ছড়িয়ে যাওয়ায় ও ট্যানারির মালিকেরা সরাসরি কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করায় এবারও পোস্তায় চামড়ার কেনাবেচা কম। গত বছর কোরবানির দিন ও তার পরের দিন মিলিয়ে পুরান ঢাকার পোস্তার আড়তদারেরা প্রায় দেড় লাখ চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এবার দুই দিনে সেই সংখ্যা লাখও ছাড়ায়নি। আড়তদারেরা বলছেন- অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী এ বছর পোস্তায় চামড়া না এনে নিজ নিজ এলাকায় চামড়া বিক্রি ও লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করছেন। আবার হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ায় আমিনবাজার ও হেমায়েতপুর এলাকায় চামড়ার অনেক আড়ত তৈরি হয়েছে। আবার কয়েক বছর ধরে ঈদের দিন থেকেই ট্যানারির মালিকেরা সরাসরি কাঁচা চামড়া কেনা শুরু করেছেন। এসব কারণে পোস্তায় চামড়ার কেনাবেচা ধীরে ধীরে কমছে।
এ প্রসঙ্গে পোস্তার আড়তদার আশিকুর রহমান বলেন- এবারের ঈদে চামড়ার সরবরাহ কম। তাঁদের ৪ হাজার চামড়া কেনার লক্ষ্য ছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত ২ হাজার চামড়া কিনতে পেরেছেন। চামড়ায় লবণ দেওয়ার জন্য ৩০০ বস্তা লবণ কিনেছিলেন আশিকুর। অথচ ১২০ বস্তা এখনো অব্যবহৃত রয়ে গেছে। আশিকুর রহমান বলেন, ট্যানারির মালিকেরা বিভিন্ন স্থান থেকে সরাসরি চামড়া কিনছেন। এ জন্য পোস্তায় কাঁচা চামড়া আসছে কম।
প্রায় কোটি পশু কোরবানি : গত সোমবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে- এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় গতবারের চেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে। এ বছর সারা দেশে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। দেশের আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে। তবে ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রাম বিভাগে গরু ও মহিষ সবচেয়ে বেশি কোরবানি হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫২১টি গবাদিপশু বেশি কোরবানি হয়েছে। গত বছর সারা দেশে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছিল।
সরকার নির্ধারিত দাম : বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা নির্ধারণ করে। ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। এ ছাড়া খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ঢাকায় ১৮ থেকে ২০ টাকা, বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে খাসির ও বকরির চামড়ার দাম একই। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন