চাটুকারদের বক্তৃতায় থাকে নেতার বন্দনা, ফলে নেতৃত্ব হয় দিকভ্রান্ত

সোহেল সানি: ভীরুরা অধিকতর ক্ষমতালিপ্সু এবং এরা আনুগত্যপ্রবণ হয়। এসব চাটুকারদের বক্তৃতায় থাকে নেতার বন্দনা। ফলে নেতৃত্বই দিকভ্রান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল। এসব চাটুকাররা ছদ্মাবরণে সমমনার মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি করে। প্রকারান্তরে এদের বলয়ে গড়ে ওঠে একটি কাপুরুষের দল। সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় এদের বক্তৃতা-ভাষণে আন্তরিকতার উল্লাস মিশ্রিত থাকে। যদি নেতার একচ্ছত্র ক্ষমতা আধিপত্য থাকে। এসব ভীরুরা ধর্মকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যা প্রকৃতপক্ষে ভীরু চাটুকারদের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধকরণের একটি লোক দেখানো প্রক্রিয়া। ক্ষমতাসীন দলে এই ভীরুদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় সরকারি আমলারা।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে, যারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অতিভক্তি বা অতিশয় আনুগত্যপ্রবণ ছিলেন, তারাই সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই বঙ্গভবনের দরবার হলে গিয়ে মন্ত্রীত্বের শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানকারীরা পতনের পর আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, প্রাণভয়ে কিংবা জান বাঁচাতেই তারা বঙ্গবন্ধুর লাশ ফেলে রেখে শপথ নেন। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তাদের ভীরুদের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি ‘কাপুরুষের দল’ বঙ্গবন্ধুর লালন-পালনে বেড়ে উঠছিলেন।

 

মোশতাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া ‘মুজিবপ্রেমিক’ খ্যাত বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েই বলেছিলেন, ‘প্রাণ বাঁচাতেই মোশতাকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন।’ মানুষের অহংবোধ যখন অতিমাত্রায় বেড়ে যায় তখন বিজয়ানুভূতি ব্যতীত অন্যসব অনুভূতি, আবেগ অপসৃত হয়ে যায়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এমন চিত্রটি দেখা যায়। নেতার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস নানারূপে সৃষ্টি হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে সাধারণত একটি নিদান হলো নেতৃত্বের বংশগত অবস্থান। যদিও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে নিজেকে এবং নিজের মাধ্যমে জাতিকে নিশ্চয়তা দিয়ে তার মহিলা-সত্ত্বাকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন। তিনি জানেন কী করা কর্তব্য- যা কোনো সাধারণ নাগরিক আশাই করেনি। তার ক্ষেত্রে জাতির ও শাসনকর্তার স্বার্থে ঐকতানিক; এ কারণেই তিনি ‘Good Administrator Bess’। তিনি ঘৃণা ক্রোধ জাগ্রত না করেই তার পিতার পাশাপাশি দেশবরেণ্য প্রয়াত নেতৃবর্গের প্রশংসা করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশদানের অভ্যাস দায়িত্ব গ্রহণ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে সহজ করে দিয়েছে। ক্ষমতার উপহার যেমন বিলাস-ব্যসন যা তার জাগতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেসব বিসর্জন দিয়েছেন। এটা বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যাপক যোগ্যতার সন্নিবেশ যা তার অনুসারীদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাভাজন হতে উদ্দীপিত করতে সক্ষম হয়েছে। মনস্তত্ত্ব নয়, কখনো কখনো তার চাতুর্যই তাকে প্রতিপক্ষ যেখানে ব্যর্থ হতো সেখানে সক্ষম হবার ক্ষমতা দিয়েছে। স্বর্গীয় ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যে একটি চরম নিরাপত্তাবোধ রয়েছে, এ বোধ কোনো নিতান্ত পার্থিব সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি।

 

মানুষ ততক্ষণ ক্ষমতা পছন্দ করে যতক্ষণ তারা বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্র পরিচালনা করবার যোগ্যতা আছে। মানুষই তাই অনুসরণ করাই শ্রেয়োবোধ করছে। সাধারণত শান্ত নাগরিকরা প্রধানত ভীতি-আক্রান্ত হয়ে নেতার অধীন হয়। যখন একবার কোনো নেতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনি দলের সম্ভাব্য বিদ্রোহীদের মধ্যে ভীতি জাগিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ অবধি তিনি নেতা না হন এবং জনগণ কর্তৃক সে-স্বীকৃতি না পান ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ভীতি জাগিয়ে তুলবার অবস্থায় থাকেন না। নেতার অবস্থান অর্জনের জন্য তাকে অবশ্যই কর্তৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী অর্জন করতে হয়। আত্মবিশ্বাস, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সঠিক মাত্রায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা হলো এই গুণাবলী। নেতৃত্ব সাপেক্ষ বিষয়। সিজার তাকে মান্য করবার জন্য ক্যান্টনিকে বাধ্য করতে পারতেন। কিন্তু অন্য কেউ তা পারতো না।

 

রাজনীতি একটি জটিল বিষয়, আর অনুসারীরা মনে করেন নেতার অনুসারী হওয়ায়ই বরং ভালো, কুকুর তার প্রভুর প্রতি যেমন মনোভাব পোষণ করে অনুসারীরাও তেমনই মনোভাব স্বতঃপ্রবৃত্ত ও অবচেতনভাবে পোষণ করে। যদি তা না হতো তবে সামষ্টিক রাজনৈতিক কার্যাবলী প্রায় অসম্ভব ছিল। প্রেষণাগত ক্ষমতা-প্রেম ভীরুতা দ্বারা সীমিত, যা আত্মপরিচালনের ক্ষেত্রকেও সীমিত করে। ক্ষমতা যেহেতু অন্যান্য সম্ভাব্যতার চাইতে অধিক পরিমাণে মানুষের ইচ্ছাকে অনুধাবন করতে সক্ষম করে এবং যেহেতু অন্যান্যের চাইতে মানুষের পার্থক্য সম্পর্কে নিশ্চিত করে, তাই যদি ভীরুতা বাধাগ্রস্ত না করে তবে ক্ষমতার জন্য আকাঙ্খা পোষণ করা স্বাভাবিক। ভীরুতা দায়িত্ববোধের অভ্যাসের প্রভাবে কমে যায়, আর তাই দায়িত্বশীলতা ক্রমে ক্ষমতার আকাঙ্খাকে বাড়িয়ে দেয়। নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা ও বন্ধুত্বহীনতা যেকোন একদিকে ধাবিত করতে পারে। যারা সহজেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাদের মধ্যে পর্যবেক্ষণ থেকে পলায়নের ইচ্ছা তৈরি হয়। অন্যদিকে সাহসিক মনোবৃত্তি এমন স্থান খুঁজে নিতে উদ্দীপিত করে যেখানে নিষ্ঠুরতা সহ্য করার বদলে তা বাধাগ্রস্ত করা যায়।

 

নৈরাজ্য পরবর্তী স্বাভাবিক প্রথম পদক্ষেপ হলো স্বৈরতন্ত্র, কারণ এটি স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে আধিপত্য ও আনুগত্যের প্রক্রিয়ার দ্বারা সহজতর হয়। সম-সহযোগিতা স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে যথেষ্ট কঠিন আর তা প্রবৃত্তির প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কম সাযুজ্যপূর্ণ। যখন সম-সহযোগিতা হবে, তখন প্রত্যেকেই মাতব্বরি করতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ আনুগত্যপ্রবণ মনোভাব তখন সক্রিয় থাকে না।

 

এক প্রকার লোকেরা দলে যুক্ত হন না বা খাপ খান না। কোনো না কোনোভাবে এমন আশ্রয়ের অন্বেষণ করেন যেখানে তারা নির্জন স্বাধীনতা ভোগ করেন। সময়ে সময়ে এই মনোভাবাপন্ন লোকদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকে। তাদের আগ্রহ নির্দোষ শখ চর্চার মধ্যে নিহিত এবং নিজেদের গূঢ় ও গুরুত্বহীন জ্ঞান চর্চায় ব্যস্ত রাখেন। তারা সভ্যতারও সীমান্ত অন্বেষণ করেন। এ ধরনের লোকদের ‘আমাজনের প্রকৃতিবাদী’ বলা হয়। আর ভীরুদের মধ্যে কেবল নেতার প্রতি আনুগত্যের দ্বারাই নয়, বরং সমমনা লোকদের মধ্যে নিশ্চিত ঐক্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে কাপুরুষদের দল গড়ে ওঠে। সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় এক আন্তরিকতার উল্লাস মিশ্রিত থাকে। মানুষের অহংবোধ যখন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায় তখন বিজয়ানুভূতি ব্যতীত অন্য সব অনুভূতিই আবেগের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে অপসৃত হয়। সমবেত উত্তেজনা আনন্দদায়ক কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন। ফলে সহজাত মানবিকতা ও আত্মরক্ষা সহজেই বিঘ্নিত হয়। তবে সহিংসতা ও শহীদের বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু সমভাবে সম্ভব। নৃশংস বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া ও বীরত্বব্যঞ্জকভাবে শহীদ হওয়া সমভাবে সম্ভব। এটাও এক প্রকার মাদকতাও যখন একবার এর আনন্দ উপভোগ করা হয় তখন প্রতিরোধ করা কঠিন। বরং পরিণামে তা অনীহা ও ক্লান্তির দিকে ধাবিত করে এবং পূর্বোক্ত উৎসাহ পুনরুজ্জীবিত করতে হলে তা তীব্র থেকে তীব্রতর উদ্দীপককে প্রয়োজনীয় করে তোলে। নেতার ক্ষমতার একটি গুরুত্ববহ উপাদান হচ্ছে সামষ্টিক উত্তেজনার আনন্দ। নেতা অনুসারীদের মধ্যে যে আবেগ সৃষ্টি করেন তাকে তার ভাগী হতে হয় এমন আবশ্যকতা নেই। কিন্তু নেতার পক্ষে তার অনুসারীদের উপর তার ক্ষমতাকে উপভোগ না করে সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। যখন একজন দক্ষ বাগ্মী যুদ্ধপ্রবণ অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে চান, তিনি শ্রোতাদের মধ্যে দুই স্তরের বিশ্বাস উৎপন্ন করেন। তিনি শত্রুর ক্ষমতা সম্পর্কে এমন উচ্চ ধারণা দেন যাতে প্রয়োজনীয় দীপ্ত সাহস জাগ্রত হয়, গভীরতর স্তরে তিনি বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস প্রদান করেন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» রাষ্ট্রপতির কাছে পরিচয়পত্র দিলেন বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত

» ড. ইউনূস চান সার্কের কার্যক্রম শুরু হোক: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

» দুদকের মামলায় হাইকোর্টে ওসি প্রদীপের স্ত্রীর জামিন

» থার্টিফার্স্ট নাইটে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ট

» সিরিয়ায় আসাদের পতন নিয়ে যা বললেন হাসনাত আব্দুল্লাহ

» জেনে রাখুন এই ভুলে গিজার বিস্ফোরণ হয়

» গাঁজা সেবন নিয়ে বিরোধে যুবক খুন, গ্রেফতার ২

» আটকে দেওয়া হলো বিএনপির তিন সংগঠনের পদযাত্রা

» ১৮ কোটি মানুষ দিল্লির আধিপত্য প্রতিহত করতে প্রস্তুত: রিজভী

» অবৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশিদের বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না: জাহাঙ্গীর আলম

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

চাটুকারদের বক্তৃতায় থাকে নেতার বন্দনা, ফলে নেতৃত্ব হয় দিকভ্রান্ত

সোহেল সানি: ভীরুরা অধিকতর ক্ষমতালিপ্সু এবং এরা আনুগত্যপ্রবণ হয়। এসব চাটুকারদের বক্তৃতায় থাকে নেতার বন্দনা। ফলে নেতৃত্বই দিকভ্রান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল। এসব চাটুকাররা ছদ্মাবরণে সমমনার মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি করে। প্রকারান্তরে এদের বলয়ে গড়ে ওঠে একটি কাপুরুষের দল। সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় এদের বক্তৃতা-ভাষণে আন্তরিকতার উল্লাস মিশ্রিত থাকে। যদি নেতার একচ্ছত্র ক্ষমতা আধিপত্য থাকে। এসব ভীরুরা ধর্মকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। যা প্রকৃতপক্ষে ভীরু চাটুকারদের অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধকরণের একটি লোক দেখানো প্রক্রিয়া। ক্ষমতাসীন দলে এই ভীরুদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয় সরকারি আমলারা।

 

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যে, যারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি অতিভক্তি বা অতিশয় আনুগত্যপ্রবণ ছিলেন, তারাই সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই বঙ্গভবনের দরবার হলে গিয়ে মন্ত্রীত্বের শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানকারীরা পতনের পর আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে বলেছেন, প্রাণভয়ে কিংবা জান বাঁচাতেই তারা বঙ্গবন্ধুর লাশ ফেলে রেখে শপথ নেন। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তাদের ভীরুদের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি ‘কাপুরুষের দল’ বঙ্গবন্ধুর লালন-পালনে বেড়ে উঠছিলেন।

 

মোশতাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া ‘মুজিবপ্রেমিক’ খ্যাত বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েই বলেছিলেন, ‘প্রাণ বাঁচাতেই মোশতাকের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন।’ মানুষের অহংবোধ যখন অতিমাত্রায় বেড়ে যায় তখন বিজয়ানুভূতি ব্যতীত অন্যসব অনুভূতি, আবেগ অপসৃত হয়ে যায়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এমন চিত্রটি দেখা যায়। নেতার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস নানারূপে সৃষ্টি হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে সাধারণত একটি নিদান হলো নেতৃত্বের বংশগত অবস্থান। যদিও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান হিসেবে নিজেকে এবং নিজের মাধ্যমে জাতিকে নিশ্চয়তা দিয়ে তার মহিলা-সত্ত্বাকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন। তিনি জানেন কী করা কর্তব্য- যা কোনো সাধারণ নাগরিক আশাই করেনি। তার ক্ষেত্রে জাতির ও শাসনকর্তার স্বার্থে ঐকতানিক; এ কারণেই তিনি ‘Good Administrator Bess’। তিনি ঘৃণা ক্রোধ জাগ্রত না করেই তার পিতার পাশাপাশি দেশবরেণ্য প্রয়াত নেতৃবর্গের প্রশংসা করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশদানের অভ্যাস দায়িত্ব গ্রহণ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে সহজ করে দিয়েছে। ক্ষমতার উপহার যেমন বিলাস-ব্যসন যা তার জাগতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, সেসব বিসর্জন দিয়েছেন। এটা বিশ্বাসের সঙ্গে ব্যাপক যোগ্যতার সন্নিবেশ যা তার অনুসারীদের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাভাজন হতে উদ্দীপিত করতে সক্ষম হয়েছে। মনস্তত্ত্ব নয়, কখনো কখনো তার চাতুর্যই তাকে প্রতিপক্ষ যেখানে ব্যর্থ হতো সেখানে সক্ষম হবার ক্ষমতা দিয়েছে। স্বর্গীয় ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের মধ্যে একটি চরম নিরাপত্তাবোধ রয়েছে, এ বোধ কোনো নিতান্ত পার্থিব সত্তার কাছে আত্মসমর্পণ করাতে পারেনি।

 

মানুষ ততক্ষণ ক্ষমতা পছন্দ করে যতক্ষণ তারা বিশ্বাস করে যে রাষ্ট্র পরিচালনা করবার যোগ্যতা আছে। মানুষই তাই অনুসরণ করাই শ্রেয়োবোধ করছে। সাধারণত শান্ত নাগরিকরা প্রধানত ভীতি-আক্রান্ত হয়ে নেতার অধীন হয়। যখন একবার কোনো নেতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তিনি দলের সম্ভাব্য বিদ্রোহীদের মধ্যে ভীতি জাগিয়ে তুলতে পারেন। কিন্তু যতক্ষণ অবধি তিনি নেতা না হন এবং জনগণ কর্তৃক সে-স্বীকৃতি না পান ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি ভীতি জাগিয়ে তুলবার অবস্থায় থাকেন না। নেতার অবস্থান অর্জনের জন্য তাকে অবশ্যই কর্তৃত্বের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলী অর্জন করতে হয়। আত্মবিশ্বাস, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সঠিক মাত্রায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা হলো এই গুণাবলী। নেতৃত্ব সাপেক্ষ বিষয়। সিজার তাকে মান্য করবার জন্য ক্যান্টনিকে বাধ্য করতে পারতেন। কিন্তু অন্য কেউ তা পারতো না।

 

রাজনীতি একটি জটিল বিষয়, আর অনুসারীরা মনে করেন নেতার অনুসারী হওয়ায়ই বরং ভালো, কুকুর তার প্রভুর প্রতি যেমন মনোভাব পোষণ করে অনুসারীরাও তেমনই মনোভাব স্বতঃপ্রবৃত্ত ও অবচেতনভাবে পোষণ করে। যদি তা না হতো তবে সামষ্টিক রাজনৈতিক কার্যাবলী প্রায় অসম্ভব ছিল। প্রেষণাগত ক্ষমতা-প্রেম ভীরুতা দ্বারা সীমিত, যা আত্মপরিচালনের ক্ষেত্রকেও সীমিত করে। ক্ষমতা যেহেতু অন্যান্য সম্ভাব্যতার চাইতে অধিক পরিমাণে মানুষের ইচ্ছাকে অনুধাবন করতে সক্ষম করে এবং যেহেতু অন্যান্যের চাইতে মানুষের পার্থক্য সম্পর্কে নিশ্চিত করে, তাই যদি ভীরুতা বাধাগ্রস্ত না করে তবে ক্ষমতার জন্য আকাঙ্খা পোষণ করা স্বাভাবিক। ভীরুতা দায়িত্ববোধের অভ্যাসের প্রভাবে কমে যায়, আর তাই দায়িত্বশীলতা ক্রমে ক্ষমতার আকাঙ্খাকে বাড়িয়ে দেয়। নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা ও বন্ধুত্বহীনতা যেকোন একদিকে ধাবিত করতে পারে। যারা সহজেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাদের মধ্যে পর্যবেক্ষণ থেকে পলায়নের ইচ্ছা তৈরি হয়। অন্যদিকে সাহসিক মনোবৃত্তি এমন স্থান খুঁজে নিতে উদ্দীপিত করে যেখানে নিষ্ঠুরতা সহ্য করার বদলে তা বাধাগ্রস্ত করা যায়।

 

নৈরাজ্য পরবর্তী স্বাভাবিক প্রথম পদক্ষেপ হলো স্বৈরতন্ত্র, কারণ এটি স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে আধিপত্য ও আনুগত্যের প্রক্রিয়ার দ্বারা সহজতর হয়। সম-সহযোগিতা স্বৈরতন্ত্রের চেয়ে যথেষ্ট কঠিন আর তা প্রবৃত্তির প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কম সাযুজ্যপূর্ণ। যখন সম-সহযোগিতা হবে, তখন প্রত্যেকেই মাতব্বরি করতে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ আনুগত্যপ্রবণ মনোভাব তখন সক্রিয় থাকে না।

 

এক প্রকার লোকেরা দলে যুক্ত হন না বা খাপ খান না। কোনো না কোনোভাবে এমন আশ্রয়ের অন্বেষণ করেন যেখানে তারা নির্জন স্বাধীনতা ভোগ করেন। সময়ে সময়ে এই মনোভাবাপন্ন লোকদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকে। তাদের আগ্রহ নির্দোষ শখ চর্চার মধ্যে নিহিত এবং নিজেদের গূঢ় ও গুরুত্বহীন জ্ঞান চর্চায় ব্যস্ত রাখেন। তারা সভ্যতারও সীমান্ত অন্বেষণ করেন। এ ধরনের লোকদের ‘আমাজনের প্রকৃতিবাদী’ বলা হয়। আর ভীরুদের মধ্যে কেবল নেতার প্রতি আনুগত্যের দ্বারাই নয়, বরং সমমনা লোকদের মধ্যে নিশ্চিত ঐক্যবোধ জাগ্রত করার মাধ্যমে কাপুরুষদের দল গড়ে ওঠে। সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফূর্ত জনসভায় এক আন্তরিকতার উল্লাস মিশ্রিত থাকে। মানুষের অহংবোধ যখন অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায় তখন বিজয়ানুভূতি ব্যতীত অন্য সব অনুভূতিই আবেগের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে অপসৃত হয়। সমবেত উত্তেজনা আনন্দদায়ক কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন। ফলে সহজাত মানবিকতা ও আত্মরক্ষা সহজেই বিঘ্নিত হয়। তবে সহিংসতা ও শহীদের বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু সমভাবে সম্ভব। নৃশংস বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়া ও বীরত্বব্যঞ্জকভাবে শহীদ হওয়া সমভাবে সম্ভব। এটাও এক প্রকার মাদকতাও যখন একবার এর আনন্দ উপভোগ করা হয় তখন প্রতিরোধ করা কঠিন। বরং পরিণামে তা অনীহা ও ক্লান্তির দিকে ধাবিত করে এবং পূর্বোক্ত উৎসাহ পুনরুজ্জীবিত করতে হলে তা তীব্র থেকে তীব্রতর উদ্দীপককে প্রয়োজনীয় করে তোলে। নেতার ক্ষমতার একটি গুরুত্ববহ উপাদান হচ্ছে সামষ্টিক উত্তেজনার আনন্দ। নেতা অনুসারীদের মধ্যে যে আবেগ সৃষ্টি করেন তাকে তার ভাগী হতে হয় এমন আবশ্যকতা নেই। কিন্তু নেতার পক্ষে তার অনুসারীদের উপর তার ক্ষমতাকে উপভোগ না করে সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব। যখন একজন দক্ষ বাগ্মী যুদ্ধপ্রবণ অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে চান, তিনি শ্রোতাদের মধ্যে দুই স্তরের বিশ্বাস উৎপন্ন করেন। তিনি শত্রুর ক্ষমতা সম্পর্কে এমন উচ্চ ধারণা দেন যাতে প্রয়োজনীয় দীপ্ত সাহস জাগ্রত হয়, গভীরতর স্তরে তিনি বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস প্রদান করেন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com