ডা. সেলিনা সুলতানা: অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার একটি স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা। কোভিড মহামারির এ সময় অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সবকিছুই নতুন দেখছে। বর্তমানে সবার ক্ষেত্রেই নতুন পরিবর্তন, নিয়ম ও রুটিন মেনে নিতে হচ্ছে।
এ সময়ে অটিজমের সাথে মোকাবিলা, মাস্ক পরিধান, সামাজিক দূরত্ব মেনে নেওয়া, বন্ধু ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার কারণে শিশু ও তার পরিবারের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
করোনা পরবর্তী সময়ে অটিস্টিক শিশুকে নতুন করে রুটিন তৈরি করে দিতে হবে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে কী কী করণীয় তা বোঝাতে হবে শিশুকে। স্কুলে ফিরে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় কৌশলগুলো পরিবারকে শিখতে হবে ও শিশুটিকে শেখাতে হবে।
নতুন রুটিন অনুযায়ী শিশুর জীবনধারা সহজ করার বিষয়ে ভাবতে হবে অভিভাবককে। থেরাপিস্ট ও পেশাদাররা বছরের পর বছর ধরে পরিবারগুলোকে শিক্ষা দিয়ে আসছেন লিখিত বা ভিজ্যুয়ালি।
শিশুর জন্য রুটিন তৈরি করা, সামাজিক দক্ষতা শেখানোর জন্য সামাজিক বর্ণনা থাকা, উপযুক্ত সময়সূচী তৈরি করা, ভিডিও মডেলিং, সংবেদনশীল বিরতি (নিরাপদ জায়গা সেঞ্চুরি ব্রেক এর জন্য) ও পুনরায় ফোকাস বা শান্ত করার জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি করা। এগুলোই কাজ লাগিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা করোনা মহামারির সময়ে।
করোনাকালে অটিস্টিক শিশুদেরকে পুরো সময়টাই ঘরে বন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। এসব শিশুদের এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তাকে বুঝতে হয়েছে কেন তার অভিভাবক ঘরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন না, স্কুলে নিচ্ছেন না, কেন সে বেড়াতে যেতে পারছে না কিংবা কেন সে থেরাপি ক্লাস গুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।
এসব প্রশ্ন শিশুর উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বা এএসডি আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তিরা আচরণের পুনরাবৃত্তিমূলক ও সীমাবদ্ধ প্রদর্শন করে। এ ধরনের শিশুরা রুটিনে সামান্য পরিবর্তনও প্রতিরোধ করে বা পছন্দ করে না।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রম বা থেরাপিগুলো ঠিকমতো না দিলে শিশুটি যা শিখেছিল তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুলে যায়। সেপ্টেম্বর মাসে স্কুল খুললেও অনেক অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ক্লাসে দেননি ভয় পেয়ে। কারণ এ ধরনের শিশুরা খুব কমই সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে চলে বা মুখে মাস্ক রাখে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অটিস্টিক শিশুদের এক্ষেত্রে ‘সংবেদনশীল সংবেদনশীলতার মাত্রা’ বা সেন্সরি সেনসিটিভিটি বেড়ে যায়। তাদের মুখে মাস্ক রাখা বা এক বেঞ্চে দীর্ঘ সময় সীমাবদ্ধ রাখা থেরাপিস্টের জন্য খুবই কঠিন কাজ। অটিস্টিক শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা এতদিন একটি পরিকল্পিত রুটিন মেনের চলার চেষ্টা করেছে।
যেখানে তারা পড়াশোনার পাশাপাশি ঘরের বিভিন্ন কাজ যেমন- পানির বোতল ভর্তি করা, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় রাখা, জামা-কাপড় ভাজ করা, শাকসবজি কাটা, বিছানা তৈরি, খাবার টেবিলে রাখা ইত্যাদি। টিভি দেখা বা খাওয়াতে তারা একত্রিতভাবে সবার সাথে মেশার চেষ্টা করেছে।
সন্ধ্যায় পুরো পরিবারের হাঁটার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়ও তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। এজন্য তাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা ছিল যেখানে তাদের পছন্দনীয় জিনিসগুলোই রাখা হত। এখন আবার নতুন করে রুটিনে পরিবর্তন আনতে হবে যা কোমলমতি শিশুদের আয়ত্তে আনতে সময় লাগবে।
বর্তমানে অনেক অটিস্টিক শিশুর মধ্যে অস্থিরতা ও আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা দিয়েছে। এ সময় অবিভাবকদের বাড়িতে স্কুলের মতো পরিবেশ তৈরি করে দেয়ার জন্য বলা হয়েছিল। এজন্য তারা অনলাইন থেরাপির সাহায্য নেন, যাতে শিশুটি নিজেকে বিচ্ছিন্ন না ভাবতে পারে।
অনেকে শিশুর সুবিধায় বাড়িতেই সব সরঞ্জামের ব্যবস্থা রেখে হোমবেজড থেরাপির ব্যবস্থা করেছেন। তবে গুরুতর অটিস্টিক শিশুদের অনলাইনে স্কুলে ক্লাস করানো কঠিন ছিল।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারে আক্রান্তরা তিনটি বিভাগে পড়ে- হালকা, মাঝারি ও গুরুতর। গুরুতর শিশুরা বেশি হাইপারঅ্যাকটিভ হয়। পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে খুব একটা পারে না ও অতিরিক্ত স্ট্রেসের জন্য বেশি সংবেদনশীল হয়।
বেশিরভাগ থেরাপিস্টদের মতে, হালকা অটিস্টিক শিশুদেরকেই অনলাইনে থেরাপি দেওয়া যেতে পারে। মাঝারি ও গুরুতরভাবে অটিস্টিক শিশুরা দীর্ঘ সময় ধরে পর্দার দিকে তাকাতে ‘অসহনশীল’ হয়। এ ধরনের শিশুদের হোম-স্কুলিংয়ের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের বড় ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।
মহামারিকালে অটিস্টিক শিশুদের মাঝে আচরণগত পরিবর্তন ও কম মনোযোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। এ শিশুরা চারপাশে হাসিখুশি মানুষের মুখ দেখতে চায় সব সময়। যদি বাবা-মাকে তারা হতাশাগ্রস্ত দেখে তা শিশুকে আরও উদ্বিগ্ন করে তোলে।
এ কারণে অভিভাবকের ধৈর্য্য শিশুটির জন্য প্রয়োজন সব সময়। অনেক সময় তারা প্রয়োজনে শিশুর জন্য একজন শিক্ষক বা ছায়া শিক্ষক নিয়োগ করেন। এ শিশুদের জন্য ব্যয়বহুল সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই। বাড়িতে থাকা সরঞ্জামগুলো দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইনক্লুসিভ স্কুলে অধ্যয়নরত শিশুটিকে আবার প্রতিদিনের মতো দীর্ঘক্ষণ মাস্ক পরার জন্য তৈরি করতে হবে। ‘নতুন স্কুলের নিয়ম’ শেখান, শিশুকে তার ডেস্কে, খাওয়া থেকে শুরু করে শ্রেণীকক্ষের সবার সঙ্গে কথা-বার্তা বলতে হবে।
একই সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা কোভিডের পরিবর্তনশীল বিশ্বে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পিাশাপাশি স্কুলের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে, যা একটু কঠিনই নিউরো ডেভলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য।
করোনা পরবর্তী সময়ে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য ‘নতুন দৈনন্দিন রুটিন’ চালু করা অপরিহার্য এখন।
এটি নিউরো ডেভলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার আক্রান্ত শিশুদের কোভিডের শিক্ষার পাশাপাশি নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে হবে।
শিশুর মাস্ক পরা বা একবার হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি অনুকরণ করলে তাদেরকে পুরস্কৃত করতে হবে। ফলে তারা একাজগুলো বারবার করতে উৎসাহিত হবে।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার ও চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল; প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল। সূএ:জাগোনিউজ২৪.কম