নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া সাহাপাড়ায় হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ও মন্দির পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, নড়াইলে হামলাকারীরা একটি অভিন্ন গোষ্ঠী। এরা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ধ্বংস করতে চায়। এ দেশে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই একসঙ্গে হাজার বছর ধরে বসবাস করছে। এটা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। একটি গোষ্ঠী আমাদের এই সম্পর্কের বন্ধন নষ্ট করতে চায়।
তিনি বলেন, যারা আমাদের এই সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায় সেই অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। তাদের দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। তারা সামনে এসে শুধু অপকর্ম করে না, তারা আড়ালে-কৌশলে নানাভাবে অপকর্ম করে। তারা সবসময় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, সরকারকে কলঙ্কিত করতে চায়। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ওপর আঘাত করতে চায়।
আজ সকালে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ঢাকা থেকে সড়কপথে দিঘলিয়ার সাহাপাড়ায় পৌঁছে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি, দোকানপাট ও মন্দির পরিদর্শন করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলেন।
পরে দিঘলিয়া সাহাপাড়া রাধা গোবিন্দ মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস। সভায় বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রতিনিধি দলের প্রধান আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কেন্দ্রীয় সদস্য শাহাবুদ্দিন ফরাজি, নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তি, নড়াইল-২ আসনের এমপি মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিন খান নিলু ও স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা শিবনাথ সাহা, শিক্ষক তরুণ সাহা ও দিলীপ সাহা।
বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, নড়াইলে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে এর কারণে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভাইবোনদের মন্দির, বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা হয়েছে। একটি সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের ঘৃণ্য ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর জন্য ও তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য এই অঞ্চলের সাহসী ও সংগ্রামী মানুষদের আমরা অভিনন্দন জানাই এবং যাদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। হয়তো তাদের ক্ষয়ক্ষতি আমরা সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে পারবো না, কিন্তু তাদের হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে সেটি কীভাবে দূর করা যায় সেটাই হলো আমাদের জন্য এখন গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আমাদের প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এ ঘটনা শুরু হওয়ার পরপরই যখনই বিষয়টা জানতে পেরেছেন তিনি খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে একজন মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, যাতে কারও জানমালের সামান্য ক্ষতি না হয় সেজন্য তিনি কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আজ আমাদের এখানে পাঠিয়েছেন আপনাদের দুঃখের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করার জন্য। এটি শুধু আমাদের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা নয় এটি বঙ্গবন্ধুকন্যার দুঃখ-কষ্ট-বেদনা এবং তিনি ঘটনায় ব্যাপক কষ্ট পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যেসব সন্ত্রাসী এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের একটি অংশকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সন্ত্রাসীরা যেই হোক বা যে দলেরই হোক তাদের শাস্তি হবে। এরা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী। এরা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। এই রকম ঘটনা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে এবং ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তারপর তদন্তের মাধ্যমে প্রকাশ পায় একশ্রেণির রাজনৈতিক গোষ্ঠী যারা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় তারাই এটি ঘটিয়েছে।
আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, এটি শুধু হিন্দু-মুসলমানের বিষয় নয়। এটি মানুষ হিসেবে সব মানুষের বিষয়। আমরা মানুষ। আমাদের মানুষ হিসেবে সবাইকে দেখতে হবে। কে কোন ধর্মের অনুসারী সেটা দেখা যাবে না। আওয়ামী লীগের কাছে ধর্ম নিয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই। যারা এমন ঘটনা ঘটাবে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এদের কোনোভাবেই রেহাই দেওয়া যাবে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করুন। এখানকার ক্ষতিগ্রস্তরা কারও ভয়ে চুপ করে আছে কি না সেটা খুঁজে বের করুন। তাদের থেকে এ ভয় ও আতঙ্ক দূর করতে হবে। এর জন্য তাদের পাশে থাকতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী না, স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক সামাজিক ব্যক্তিদেরও তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
মতবিনিময় সভায় নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা বলেন, শান্তিপ্রিয় নড়াইলে যারা এ ঘৃণীত ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের অবশ্যই বিচার হবে। আপনাদের সাহস বাড়াতে হবে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। আমরা আপনাদের পাশে সবসময় ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতে থাকবো।
সভা শেষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে নগদ টাকা প্রদান করা হয়। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান, পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায়, নড়াইল পৌরসভার মেয়র আঞ্জুমানয়ারা, স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আফজালুর রহমান বাবু, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি নির্মল চ্যাটার্জি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খায়রুল হাসান জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল সায়েম, সাংগঠনিক সম্পাদক শাহজালাল মুকুল, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুন্সি আলাউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র সৈয়দ মসিয়ূর রহমান প্রমুখ।
লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আবু হেনা মিলন জানান, বর্তমানে ওই এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। সাম্প্রদায়িক হামলা দায়ের করা মামলায় বাগডাঙ্গা গ্রামের হারেজ মীরের ছেলে ওসমান মীরসহ (৩২) বুধবার পর্যন্ত মোট সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
গত শুক্রবার দিঘলিয়া সাহাপাড়ার আকাশ সাহার ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি, দোকান ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিক্ষুদ্ধ লোকজনকে লাঠিপেটা করে এবং টিয়ারশেল ও শর্টগানের ফাঁকা গুলি ছোড়ে।,