মামলা, গ্রেপ্তার আতঙ্ক। ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের পাশাপাশি যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের সোর্সদের বিরুদ্ধে। সহযোগিতা করছেন পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য। তাই গ্রেপ্তারের ভয়ে থাকা পুরুষদের পাশাপাশি সোর্স আতঙ্কে নারীরা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে নেমে আসে আতঙ্কের রাত। পুরুষরা ঘরের বাইরে আর নারীরা নিরাপত্তার জন্য থাকেন মা, বোন, ভাইসহ ঘনিষ্ঠ সঙ্গে। তবুও রেহাই পাচ্ছেন না তারা। নির্যাতিতা নারীরা জানিয়েছেন, যৌন সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেয় চক্রটি নতুবা গ্রেপ্তার করার হুমকি দেয়।
ইতিমধ্যে কয়েক নারী মুখ খুললেও অনেকেই নিরবে এই নির্যাতন সহ্য করছেন। এছাড়াও সোর্স পরিচয় দিয়ে দীর্ঘদিন অবাধে মাদক ব্যবসা করছে চক্রটি। এ বিষয়ে ঢাকা মেট্টোপলিটন কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ করার পর শুরু হয়েছে তদন্ত। ইতিমধ্যে এই চক্রের সদস্য জাম্বু কালিমকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
জেনেভা ক্যাম্পে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে মোহাম্মদপুর থানায়। পুলিশের দায়েকৃত দুটি মামলায় ১০৪ জন এজাহার নামীয় ছাড়াও অজ্ঞাত আসামি অনেক। অভিযোগ উঠেছে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করছে একটি চক্র। এছাড়াও মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে কিছু নিরীহ নারীদের জিম্মি করছে তারা। চক্রের হোতা জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়ী জাম্বু কালিম গ্রেপ্তার হলেও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা হুমকি ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। অবাধে যৌন হয়রানি করছে নারীদের। সামাজিক কারণে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন কয়েক নারী।
এক নারী জানান, বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। রাত তখন প্রায় ১০টা। হঠাৎ তার বাসার সামনে থামে পুলিশের ভ্যান। ঘরে ঢুকে পুলিশ। এসআই সজীব, এসআই হাসানসহ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে জাম্বু্বু কালিম। তাকে দেখেই আঁতকে উঠেন ওই নারী। বাসা তল্লাশি করে নগদ টাকাসহ ওই নারীর স্বামীকে আটক করা হয়। ওই সময়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে নিতে বারবার অনুরোধ করেন স্ত্রী। ঠিক তখনই প্রস্তাব দেয় জাম্বু কালিম। ওই নারীর ভাষ্যমতে, ‘আমাদের খুশি করে দে, তোর জামাইকে ছেড়ে দেব।’ এভাবেই প্রস্তাব দেয় সে।
ওই নারী প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে পরদিন পুলিশের বরাত দিয়ে তার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে জাম্বু কালিম। এতে অপারগতা প্রকাশ করলে স্বামীকে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তারপরও থেমে থাকেনি এই চক্রটি। একইভাবে বারবার প্রস্তাব দেয়া হয়। রিমান্ডে আনা হবে না, জামিনের ব্যবস্থা করানো হবে- এরকম নানা প্রলোভন।
একইভাবে আরেক নারীকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে যৌন হয়রানি করে যাচ্ছে জাম্বু কলিম। গত ২৫শে অক্টোবর জেনেভা ক্যাম্পের সাত নম্বর সেক্টরে ওই নারীকে একই প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হন ওই নারী। বাগে আনতে না পেরে তখন প্রকাশ্যে রাস্তায় মারধর করা হয় ওই নারীকে। এসব বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার সুবাধে নিজেরা অবাধে মাদক ব্যবসা করছে। অন্যদিকে নিরীহ নারীদের মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে যৌনকর্মে বাধ্য করছে চক্রটি। মোহাম্মদপুর থানার দুই এসআই’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে চক্রটির। যে কারণে থানা পুলিশে অভিযোগ জানিয়েও কোনো সুফল পাওয়া যায় না বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। একাধিক মাদক মামলার আসামি জাম্বু কালিম ছাড়া আসলাম, সেলিম, বশির কসাই ও ক্যাম্পের সাত নম্বর সেক্টরের এক নারীসহ অন্তত ১০-১২ জন রয়েছে এই চক্রে।
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, পুলিশের সঙ্গে বিহারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার অজ্ঞাত আসামির সুবিধা নিচ্ছে এই চক্র। এই চক্রের সঙ্গে থানা পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যারা সেদিন ক্যাম্পে ছিলো না, সংঘর্ষে অংশ নেয়নি তাদেরকেও পুলিশকে ভুল তথ্য দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এসব বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোপাল গনেশ বিশ্বাস বলেন, কোনো মাদক ব্যবসায়ী আমাদের সোর্স না। আমাদের এরকম কোনো সোর্স নেই। কমিউনিটি পুলিশ রয়েছে, অন্য সোর্সের দরকার নেই। সোর্স পরিচয়ে কেউ অপকর্ম করলে, তথ্য প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
সূত্রমতে, এই চক্রটির মূল হোতা মাদক ব্যবসায়ী ইসতিয়াক। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর আত্মগোপনে থাকলেও তার ঘনিষ্ঠ জাম্বু কালিমকে দিয়ে এই ব্যবসা পরিচালনা করছিলো।
গত ২৭শে নভেম্বর ৫০ গ্রাম হেরোইনসহ জাম্বু কালিমকে গ্রেপ্তার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। জাম্বু কালিম গ্রেপ্তার হলেও সক্রিয় রয়েছে এই চক্রের সদস্য পারভেজ, শাকিল, আরসাদ, মোল্লা আনোয়ার, আলমগীর, জসিম, মাহমুদ পটল, সান্নু, বাবু, আরমান, টেরু সেলিম, বেজি নাদিম, শাহজাদা, চায়না সুমন, জিলানী, আসলাম, সাজু, মোস্তফা মনু, গাপ্পি, সেলিম, বশির কসাই, সান্নু,বাবু, ইমরান, লাম্বু মনু, পেলু আরমান, পলুর স্ত্রী শিমা,পাখি, রোজিনা।
এসব বিষয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (পশ্চিম)’র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. আনিস উদ্দিন জানান, জাম্মু কালিমসহ এই চক্রের সদস্য মূলত মাদক ব্যবসায়ী ইসতিয়াকের লোক। জাম্মুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাদকসহ অপকর্মে জড়িত অন্যদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে ডিবি পুলিশ সক্রিয় রয়েছে বলে জানান তিনি।মানবজমিন